গণমাধ্যমকে ‘শায়েস্তা’ করা বন্ধ করুন, শামসুজ্জামানকে মুক্তি দিন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করুন। বৃহস্পতিবার (৩০ মার্চ) দুপুরে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এসব দাবি জানায় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে তার বাসা থেকে গভীর রাতে তুলে নেওয়া, ৩০ ঘণ্টা পর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে হাজির করার ঘটনায় এক বিবৃতিতে তীব্র নিন্দা জানিয়েছে টিআইবি।
সংস্থাটি মনে করে, এই ঘটনা একজন সাংবাদিক, দেশের একজন নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তার সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করেছে। পাশাপাশি গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণের এবং প্রয়োজনে শায়েস্তা করার ভয়ংকর উদাহরণ তৈরি করেছে।
আজ গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে সাংবাদিক শামসুজ্জামানের নিঃশর্ত মুক্তি এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অবিলম্বে বাতিলের দাবি জানায় টিআইবি।
শামসুজ্জামানকে দৃশ্যত অবৈধভাবে তুলে নিয়ে যাওয়ার ৩০ ঘণ্টা পর আদালতে উপস্থাপন এবং মাঝের সময়টিতে নিখোঁজ থাকার ঘটনাকে ন্যক্কারজনক উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বিবৃতিতে বলেন, সংবাদকর্মী হিসেবে তো বটেই, একজন নাগরিক হিসেবেও শামসুজ্জামানের সাংবিধানিক অধিকার মারাত্মক লঙ্ঘন করা হয়েছে। কেননা, বিদ্যমান আইন অনুযায়ী কোনও ব্যক্তিকে যদি আইনগতভাবে আটক করা হয়, আটকের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে উপস্থাপন করার যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তা করতে পরিষ্কারভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি যে মামলায় আটক দেখিয়ে তাকে আদালতে তোলা হয়েছে, সেটিও দায়ের করা হয়েছে তুলে নেওয়ার ২০ ঘণ্টারও পরে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, গণমাধ্যমে প্রকাশিত যে কোনও প্রতিবেদনের ভুল বা অসঙ্গতি থাকলে কেউ তা নিয়ে সংক্ষুব্ধ হতে পারেন এবং তা নিরসনের জন্য দেশে প্রেস কাউন্সিল আইন রয়েছে। বিদ্যমান সেই আইন অনুযায়ীই ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
তিনি বলেন, প্রেস কাউন্সিল আইনকে উপেক্ষা করে সরাসরি কোনও প্রতিবেদককে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অজামিনযোগ্য ধারায় গ্রেফতার দেখানো, গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণে রাখার এবং সমালোচনামূলক বা ভিন্নমত প্রকাশ করলে শায়েস্তা করার সরকারি অভিপ্রায়কে স্পষ্ট করে তোলে। যা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের নামান্তর।
প্রকাশিত খবর অনুযায়ী জানা যাচ্ছে, শামসুজ্জামানকে যে মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে তাতে সংশ্লিষ্ট সংবাদপত্রের সম্পাদক, সহযোগী ক্যামেরাম্যানসহ অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫(২), ৩১ ও ৩৫ ধারায় মামলা করা হয়েছে, এরমধ্যে ৩১ ধারা অজামিনযোগ্য।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিভিন্ন ধারার কথা উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, এসব ধারার যথেচ্ছ ব্যবহারের মাধ্যমে ভিন্নমত পোষণকারী বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ, বিশেষ করে সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। গত দুই দিনে আরও দুই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়েছে। এই কালাকানুন তৈরির সময় থেকেই টিআইবি সবসময় আইনটির বিভিন্ন ধারা সম্পর্কে উদ্বেগ ও আপত্তি জানিয়ে আসছে। এমনকি আইনমন্ত্রীও এই আইনের অপব্যবহারের পরিপ্রেক্ষিতে আইনটি সংশোধনের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তারপরও এই আইনের মাধ্যমে সংবাদকর্মী ও ভিন্ন মতাবলম্বীরা নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। অজামিনযোগ্য ধারায় মামলা হওয়ার কারণে অপরাধ প্রমাণিত না হলেও অভিযুক্তকে “শায়েস্তা” করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে এবং তা করাও হচ্ছে।
বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচক ২০২২-এর কথা উল্লেখ করে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬২। যা কিনা তালেবান নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তানের (১৫৬) চেয়েও নিচে। এই অবস্থান নিবর্তনমূলক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও শাসক দলের মাধ্যমে তার যথেচ্ছ অপপ্রয়োগের প্রতিফলন। তাই অবিলম্বে শামসুজ্জামানের নিঃশর্ত মুক্তি ও মামলা প্রত্যাহারের পাশাপাশি গণমাধ্যম ও ভিন্নমতাবলম্বীর কণ্ঠরোধকারী নিবর্তনমূলক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি জানাচ্ছে টিআইবি।