পদ্মা সেতু পার হয়ে মাওয়া প্রান্তে পৌঁছলো ট্রেন 

ট্রেন উঠলো পদ্মা সেতুতে। মঙ্গলবার (৪ এপ্রিল) পরীক্ষামূলকভাবে একটি বিশেষ ট্রেন পদ্মা সেতু অতিক্রম করেছে। বাংলাদেশ রেলওয়ের ৬৬২১ নম্বর ইঞ্জিন পরিচালিত ৫টি বগি বিশিষ্ট ট্রেনটি ভাঙ্গা স্টেশন থেকে ৪২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পদ্মা সেতু পার হয়ে মাওয়া প্রান্তে পৌঁছে। ট্রেনটি ঠিক ২টা ৪৮ মিনিটে পদ্মা সেতুর রেল ট্র্যাকে প্রবেশ করে এবং ৩টা ৩ মিনিটে সেতু অতিক্রম করে। ট্রেনটি আবার ভাঙ্গা ফিরে যাওয়ার কথা রয়েছে।

এর আগে ভাঙ্গা থেকে সেতুর জাজিরা প্রান্ত পর্যন্ত পরীক্ষামূলক গ্যাংকার ট্রেন চললেও মূল সেতুতে ট্রেন আজই  প্রথম উঠলো। এর মাধ্যমে মাদারীপুর, শরীয়তপুর এবং মুন্সিগঞ্জ জেলার ওপর দিয়ে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ট্রেন চললো। ট্রেনের গতি ছিলে ঘণ্টায় ২৫ কিলোমিটার।

দ্বিতল বিশিষ্ট পদ্মা সেতুর নিচে রেল এবং উপরে গাড়ি চলাচলের জন্য নির্ধারিত। গত বছর ২৫ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সড়ক অংশের উদ্বোধন করেন। পরদিন ২৬ জুন থেকে সেতুর ওপর দিয়ে যান চলাচল শুরু হয়।

রেলপথ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন, চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী এনামুল হক শামীম, আব্দুস সোবহান গোলাপসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা এবং গণমাধ্যমকর্মীরা প্রথম যাত্রী হিসেবে পরীক্ষামূলক ট্রেনে ভাঙ্গা থেকে মাওয়া আসেন।

১৫ মিনিটে পদ্মা সেতু পার হলে ট্রেনএর আগে বেলা ১টার দিকে ভাঙ্গা স্টেশন থেকে রেলমন্ত্রী পরীক্ষামূলক ট্রেন যাত্রার উদ্বোধন করেন।

দেশের দীর্ঘতম পদ্মা সেতুতে গাড়ি চলাচল গত বছর ২৫ জুন শুরু হলেও রেল চলাচল এখনও শুরু হয়নি। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে আংশিক রেল যোগাযোগ শুরু হতে পারে বলে জানা গেছে।

পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের আওতায় ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হবে। ২০২৪ সালের ৩০ জুনের মধ্যে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত রেলপথ চালু হওয়ার কথা রয়েছে।

২০১৬ সালের মার্চে পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এ প্রকল্পটির মাধ্যমে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত রেল লাইন নির্মাণ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে চীনের এক্সিম ব্যাংক ২১ হাজার ৩৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছে। সরকারি অর্থায়ন ১৮ হাজার ২১০ কোটি টাকা। এই প্রকল্পের ঠিকাদার চীনের চায়না রেলওয়ে গ্রুপ। পদ্মা রেলসেতু প্রকল্পের আওতায় চীন থেকে ১০০টি নতুন ব্রডগেজ কোচ আনা হবে। এসব কোচ দিয়ে পদ্মা সেতুর রেললাইনের ওপর ট্রেন চলবে। ইতোমধ্যে ৪৫টি কোচ বাংলাদেশে এসে পৌঁছেছে। সেগুলো নীলফামারীর সৈয়দপুরে রেলওয়ে কারখানায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। সৈয়দপুর কারখানায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ৫টি বগি বিশিষ্ট একটি ট্রেন রাজবাড়ি-ফরিদপুর হয়ে আনা হয়। এ ট্রেনটি দিয়ে ট্রায়াল রান সম্পন্ন হলো। বাকি কোচগুলো ধাপে ধাপে আসবে।

পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের আওতায় ঢাকা থেকে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা ও নড়াইল হয়ে যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার রেলপথে নতুন ১৪টি স্টেশন ও ৬৬টি বড় সেতু রয়েছে। এছাড়া ৬টি পুরনো স্টেশন পুনর্নির্মাণ ও ২৫৪টি ছোট সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে।

পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পটি প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারভুক্ত (ফার্স্ট ট্র্যাক) এ প্রকল্পের কাজ তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে— ঢাকা থেকে মাওয়া, মাওয়া থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা এবং ভাঙ্গা থেকে যশোর।

প্রকল্পটি সম্পন্ন হলে মুন্সিগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও নড়াইল জেলা রেলের আওতাভুক্ত হবে। এই রেল যোগাযোগ ব্যবস্থায় দেশের মধ্য ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানী ঢাকা এবং পদ্মা সেতুর মাধ্যমে নতুন দিগন্ত উন্মুক্ত হবে। প্রকল্পটির মাধ্যমে ঢাকা-যশোর-খুলনার মধ্যে ২১২.০৫ কিলোমিটার সংক্ষিপ্ত রুট এবং উন্নত পরিচালন সুবিধার বিকল্প রেলপথ সংযোগ স্থাপিত হবে। এছাড়া বিদ্যমান ভাঙ্গা-পাচুরিয়া-রাজবাড়ী রেল সেকশনটি পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হবে।

এটি বাংলাদেশে ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আরেকটি সাব-রুট স্থাপন এবং জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক মালবাহী এবং বিজি কনটেইনার ট্রেন পরিষেবা চালু করবে। এই রুটটি কনটেইনার পরিবহনের ক্ষেত্রে গতি এবং লোড সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত হবে। রেল চালু হলে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের চমক দেখা যাবে।

পদ্মা রেল সেতুর সার্বিক অগ্রগতি

পদ্মা রেল প্রকল্পের সার্বিক ভৌত অগ্রগতি ৭৪ শতাংশ। তিনটি অংশে বিভক্ত এ প্রকল্পের মাওয়া-ভাঙ্গা অংশের অগ্রগতি সব থেকে বেশি। এ অংশের অগ্রগতি ৯১ শতাংশ। এর মধ্যে ৪২.২০ কি. মি. রেললাইনের পুরোটাই স্থাপন সম্পন্ন হয়েছে। ১৩টি মেজর ব্রিজ নির্মাণের পুরোটাই শেষ হয়েছে।  ৪টি নতুন স্টেশন নির্মাণ কাজের অগ্রগতি ৬৮ শতাংশ। ৪টি স্টেশনের সিগন্যালিং ওয়ার্কের দুটির কাজ চলমান।

ঢাকা-মাওয়া অংশের অগ্রগতি ৭২ শতাংশ। এ অংশের কাজের মধ্যে ৩৯.৬৩ কিমি রেললাইনের মধ্যে ১২ কিলোমিটার স্থাপন হয়েছে। ৪টি স্টেশনের কাজের অগ্রগতি ৩০ শতাংশ। ১৫টি মেজর ব্রিজের মধ্যে ১৩টির কাজ শেষ হয়েছে।

ভাঙ্গা-যশোর অংশের অগ্রগতি ৬৮ শতাংশ। এর মধ্যে ৮৩ দশমিক ১৬ কিমি বাধ নির্মাণের অগ্রগতি ৯৩ শতাংশ। ৯টি স্টেশনের মধ্যে ৭টির কাজ চলমান, কাজের অগ্রগতি ১৭ শতাংশ। ৩২টি মেজর ব্রিজের মধ্যে ২৬টি নির্মাণ শেষ হয়েছে, ৬টির কাজ চলমান। ১৬৮টি মাইনর ব্রিজের মধ্যে ১৬১টির কাজ শেষ হয়েছে।