বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের স্মৃতি রক্ষায় ৪৮১ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করেছে সরকার। ফরিদপুর-সংলগ্ন মধুমতি নদীর বামতীরের ভাঙনে বিলীন হওয়ার পথে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের স্মৃতি জাদুঘর।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ‘ফরিদপুর জেলাধীন মধুমতি নদীর বামতীরের ভাঙন থেকে শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ স্মৃতি জাদুঘর সংযোগ রাস্তাসহ অন্যান্য এলাকা সংরক্ষণ ও ড্রেজিং’ শীর্ষক একটি প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি একনেকের অনুমোদন পেয়েছে।
এদিকে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সরকারি অর্থায়নে ৪৮১ কোটি ১০ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে প্রকল্পটি ২০২২ সালের জনুয়ারিতে শুরু হওয়ার কথা থাকলেও কাজ শুরু হয়েছে ২০২৩ সালের জুনে। এ কারণেই প্রকল্পটি শতভাগ বাস্তবায়নের মেয়াদ ২০২৫ সালের জুনের পরিবর্তে ২০২৬ সালের জুন নির্ধারণ করা হয়েছে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে নেওয়া প্রকল্পটি ফরিদপুরের মধুখালী ও আলফাডাঙ্গা উপজেলা এলাকায় বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বাপাউবো) বাস্তবায়ন করবে।
কমিশন জানিয়েছে, প্রকল্পটির আওতায় বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ স্মৃতি জাদুঘর ছাড়াও মধুমতি নদীর তীর সংরক্ষণমূলক কাজ বাস্তবায়নের মাধ্যমে নদীভাঙন রোধ এবং বন্যার হাত থেকে স্থানীয় জনগণকে রক্ষা করা, নদী ড্রেজিং দ্বারা নদীর প্রবাহ বা নাব্য স্বাভাবিক রাখা, ফরিদপুরের মধুখালী ও আলফাডাঙ্গা উপজেলার আটটি প্রবল নদীভাঙনকবলিত স্থানে বিদ্যমান সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি, বিদ্যালয়, হাটবাজার, রাস্তা, ব্রিজ, ফসলি ও বাসযোগ্য জমি, কমিউনিটি ক্লিনিক, ধর্মীয় উপাসনালয়সহ বিভিন্ন স্থাপনাসহ আনুমানিক ২ হাজার ৭৭২ কোটি ২৫ লাখ টাকার সম্পত্তি রক্ষা করা সম্ভব হবে।
জানা গেছে, মহান মুক্তিযুদ্ধে নিহত শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলায় সালামতপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৩ সালে তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসে (ইপিআর) (পরে বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর) ও বর্তমানে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)) যোগদান করেন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি অষ্টম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে যুক্ত হয়ে যুদ্ধ শুরু করেন। ১৯৭১ সালের ৮ এপ্রিল রাঙামাটির মহালছড়ি নৌপথে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং নিজের মেশিনগান দিয়ে শত্রুপক্ষের দুই প্লাটুন সৈন্যকে খতম করেন। প্রবল গোলাবর্ষণের পরও তিনি নিজের অবস্থানে স্থির ছিলেন। কিন্তু হানাদার বাহিনীর একটি মর্টারের আঘাতে তিনি শাহাদাৎবরণ করেন। তার এই আত্মত্যাগের জন্য তাকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের উদ্যোগে গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়। পরে স্থানীয় ৫৬ জন ব্যক্তি জাদুঘর স্থাপনের জন্য জায়গা দান করেন। বীরশ্রেষ্ঠর মা মফিদুন্নেসা জাদুঘরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে এক একর জায়গার ওপর তিন হাজার ৫৩৫ বর্গফুট আয়তনবিশিষ্ট জাদুঘরটি প্রায় ৬২ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়। ২০০৮ সালের ২৮ মে সাবেক খাদ্যমন্ত্রী লে. জেনারেল (অব.) মীর শওকত আলী জাদুঘরটি উদ্বোধন করেন।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানিয়েছে, প্রকল্পের আওতায় মধুমতি নদীর ৭ দশমিক ৫০ কিলোমিটার নদীতীর সংরক্ষণ করা হবে এবং ৩ দশমিক ১০ কিলোমিটার নদীর চর অপসারণের জন্য নদী ড্রেজিং করা হবে। প্রকল্পটি চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (আরএডিপি) বরাদ্দবিহীন অননুমোদিত নতুন প্রকল্প তালিকায় প্রাক্কল্লিত ব্যয় ৪৮১ কোটি ১৫ লাখ টাকা বরাদ্দসহ অন্তর্ভুক্ত আছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, সরকারের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার পানিসম্পদ সেক্টরের অন্যতম উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হচ্ছে নদীতীর সংরক্ষণ, নদী বা খাল খনন বা পুনঃখননের মাধ্যমে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নিষ্কাশনব্যবস্থার উন্নয়ন, নদীভাঙন রোধ করে দুর্যোগঝুঁকি প্রশমন ও মানুষের জীবনমান উন্নয়ন করা। এ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের সঙ্গে প্রস্তাবিত প্রকল্পটির কার্যক্রম সামঞ্জস্যপূর্ণ। এ ছাড়া টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজির (টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা) নির্দেশক ৬.৫.১ সমন্বিত পানি ব্যবস্থাপনার সঙ্গেও প্রকল্পটি সংগতিপূর্ণ।
একনেকে অনুমোদন চেয়ে পরিকল্পনা কমিশন তাদের মতামতে বলেছে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ফরিদপুর জেলাধীন মধুমতি নদীর বাম তীরের সংরক্ষণমূলক কাজ এবং ড্রেজিং কাজ বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রকল্প এলাকায় বিদ্যালয়, শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ স্মৃতি জাদুঘর, হাটবাজার, রাস্তা, ব্রিজ, ফসলি ও বাসযোগ্য জমি, বসবাসের বাড়ি-ঘর, ধর্মীয় উপসানালয়, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনা ইত্যাদি রক্ষা করা সম্ভব হবে।
এ প্রসঙ্গে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক জানিয়েছেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত এই প্রকল্পটির মাধ্যমে শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ স্মৃতি জাদুঘর সংযোগ রাস্তাসহ অন্যান্য এলাকা সংরক্ষণ সম্ভব হবে। এর মধ্য দিয়ে স্থানীয় ৫৬ জন ব্যক্তির দান করা জমিতে স্থাপিত জাদুঘরটি রক্ষার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের স্মতি ধরে রাখা সহজসাধ্য হবে।
তিনি বলেন, শুধু শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ স্মৃতি জাদুঘরই নয়, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে মধুমতি নদীর বাম তীরের ভাঙন থেকে মধুখালী ও আলফাডাঙ্গা উপজেলার হাটবাজার, রাস্তা, ব্রিজ, ফসলি ও বাসযোগ্য জমি, বসবাসের বাড়ি-ঘর, ধর্মীয় উপসানালয়, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনা ইত্যাদি রক্ষা করা সম্ভব হবে।