জার্নি বাই ট্রেন: ঢাকা টু ভাঙ্গা ভায়া পদ্মা সেতু

“এক স্বপ্ন সত্যি হইছে পদ্মা সেতু হয়ে, আরেক স্বপ্ন পূরণ হইতেছে রেল চালু হয়ে। এই দুই স্বপ্ন আমাগো অনেক দিনের, স্বাধীনের আগের। এখন বাসে দিনে দিনে যাইতে-আইতে পারি। রেলে যাতায়াতে আরও বেশি সুবিধা। বাসের চেয়েও কম খরচে রেলে চলাচল করতে পারবো। ঈদের সময়ও শান্তিতে চলতে-ফিরতে পারবো। সবচেয়ে বড় কথা হলো—বইয়ে পড়া ইংরেজি রচনা 'জার্নি বাই ট্রেনে'র মতো মনে হচ্ছে।”373361062_741756914422964_4992066896031222956_n

প্রথমবারের মতো আজ বৃহস্পতিবার (৭ সেপ্টেম্বর) একটি যাত্রীবাহী ট্রেন ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ভাঙ্গায় যায়। সেটি দেখে সদর থানার বাসিন্দা আরিফ হোসেন উপরের কথাগুলো যখন বলছিলেন, তার আশপাশে এই ট্রেনকে বরণ করে নিতে যেন রীতিমতো মেলা বসেছিল। নতুন তৈরি করা রেললাইনের দুই পাশে রঙিন পতাকা বাতাসে উড়ছে। তাতে ইংরেজি এবং চীনা ভাষায় লেখাও শোভা পায়। চারদিকে সাজ সাজ রব।কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে ভাঙার উদ্দেশে রওনা হয় ট্রেনটি

ভাঙ্গা রেল স্টেশনে ট্রেনটি পৌঁছালে দেখা যায় প্ল্যাটফর্ম ঘেঁষে সারি সারি গাড়ি থামানো। সেগুলোতে চড়ে আসা স্থানীয় সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধি, সরকারি দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী আর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ট্রেনটিকে স্বাগত জানান। এ সময় বিপুল সংখ্যক স্থানীয় মানুষকে রেলস্টেশনে সমবেত হতে দেখা যায়। তাদের অনেকেই হাত নেড়ে ট্রেনকে স্বাগত জানান, কথা বলতে গেলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন।ট্রেনের চালক

ট্রেনটি সকাল ১০টা ৭ মিনিটে ঢাকা থেকে ছেড়ে দুপুর ১২টা ১৭ মিনিটে ভাঙ্গা স্টেশনে পৌঁছায়। বেশ কয়েকটি স্টেশন হয়ে পদ্মা সেতু দিয়ে ট্রেনটিকে গন্তব্যে যেতে সময় লাগলো ২ ঘণ্টা ১০ মিনিট (১৩০ মিনিট)। ট্রেনটি আবারও ১টা ৩৫ মিনিটে ভাঙ্গা স্টেশন থেকে যাত্রা শুরু করে ঢাকায় এসে পৌঁছায় বিকাল ৪টা ৭ মিনিটে।373348089_1388952421968175_1695227986738663436_n

কর্তৃপক্ষ বলেছে, পরীক্ষামূলক যাত্রা হওয়ায় সময় বেশি লেগেছে। পুরোদমে চালু হলে আরও কম সময়ে এই দূরত্ব পাড়ি দেবে। এতে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর রাজধানীতে যাতায়াতের সময় ও খরচ সাশ্রয় হবে। সেই সঙ্গে উত্তরবঙ্গের চেয়ে এই অঞ্চলের মানুষ আরও স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচল করতে পারবে।

373345617_1005784337232053_6464646801096328962_nআতাহার মিয়া নামে পঞ্চাশোর্ধ্ব আরেকজন ট্রেনের কাছে এসে বলছিলেন, 'আপনারা ঢাকা থেকে আসছেন। পদ্মা সেতু দিয়ে আসতে কেমন লাগলো? আমরাও ট্রেনে চড়ে ঢাকা যাবো-আসবো। বাসে তো আমরা পদ্মা সেতু দিয়ে ঢাকা যাই। এবার ট্রেনেও যাবো-আসবো। বঙ্গবন্ধুর মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ আমাদের স্বপ্ন পূরণ করেছেন। এতদিন আমরা অবহেলিত ছিলাম। এখন আর আমাদের কেউ অবহেলা করতে পারবে না।'373361899_853059399566681_4391395746815731504_n

তিনি যখন এমন কথা বলছিলেন, তখন পাশে থাকা অন্যরাও মাথা নেড়ে তার কথায় সায় দিচ্ছেন। যেন তাদের সবার মনের কথাই বলছিলেন কৃষিকাজ করা আতাহার মিয়া। আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলতে গেলে ঘুরেফিরে প্রায় একই ধরনের অভিব্যক্তি পাওয়া যায়।

373396497_995850998308516_3364832054874523494_nতারা বলছিলেন, স্বাধীনতার পর থেকে পদ্মা নদীতে সেতু না থাকায় ফেরিতে চলাচল করায় নানা ভোগান্তিতে পড়তে হতো। সে কারণে একটা সেতুর দাবি জানিয়ে আসছিলেন দীর্ঘদিন থেকে। সেই বহুল কাঙ্ক্ষিত সেতুটি হওয়ায় নদীর ওপারের মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হয়ে গেছে। এখন পদ্মা সেতু দিয়ে বাসের পাশাপাশি ট্রেনও চলবে। তাতে বাসের চেয়েও কম খরচে রাজধানীতে চলাচল করার আশা করছেন তারা। এসব কারণে স্থানীয়রা বেশ উচ্ছ্বসিত।373393600_833507948183447_558810853856978789_n

এদিকে ট্রেনটি ঢাকা শহর ছেড়ে ভাঙ্গার উদ্দেশে এগিয়ে চলার পথে রেললাইনের আশপাশের মানুষকে দাঁড়িয়ে উপভোগ করতে দেখা যায়। পুরো পথে দেখা গেছে একই দৃশ্য, অনেকে হাত নেড়ে স্বাগত জানাচ্ছেন, অনেকে অবাক বিস্ময়ে দেখেছেন। আসার পথেও সেই একই দৃশ্যপট। উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে, হাত নেড়ে অভিবাদন জানায় সাধারণ মানুষ।373353123_2654952461319346_7517790457473834579_n

স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন হয়েছে গেলো বছরের ২৫ জুন। চলতি বছরের ৪ এপ্রিল প্রথমবারের মতো সেতুটি দিয়ে ভাঙ্গা থেকে মাওয়া প্রান্তে পরীক্ষামূলকভাবে চলাচল করে ট্রেন। এবার প্রথমবারের মতো ঢাকা থেকে ভাঙ্গা ট্রেনের ‘ট্রায়াল’ হলো আজ।

আগামী ১০ অক্টোবর নতুন এই রুটে আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রেন চলাচলের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এতে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের ট্রেনে চড়ে রাজধানীতে আসা-যাওয়ার বহুল কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন খুব সহজেই পূরণ হতে যাচ্ছে বলে আশা সংশ্লিষ্টদের।373368408_238092972071416_2367689505239992542_n

ভাঙ্গা রেল স্টেশনে সংবাদ সম্মেলনে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেছেন, আগামী ১০ অক্টোবর ঢাকা-ভাঙ্গা রেল চলাচল উদ্বোধনের পর খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বাণিজ্যিকভাবে ট্রেন চলাচল করবে। আর আগামী বছরের জুন মাসেই যশোর পর্যন্ত এই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। এই রেলপথকে কাজে লাগিয়ে ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগের সময় ও খরচ কমবে। ঢাকা থেকে খুলনার যে দূরত্ব তা অর্ধেকে নেমে আসবে।

তিনি বলেন, যাতায়াত, মালামাল পরিবহনে অনেক সুবিধা পাবে মানুষ। এতে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবেন এই অঞ্চলের মানুষ। কলকাতার সঙ্গে যারা ব্যবসা-বাণিজ্য করে তাদের আর বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে মালামাল পরিবহন করতে হবে না। ঢাকা-যশোর রেলপথ পুরোপুরি চালু হলে ঢাকা থেকে সরাসরি এই পথ ব্যবহার করা যাবে।373347547_615692000741645_6788064334966221838_n

১৭২ কিলোমিটার ঢাকা-যশোর রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের অগ্রগতি সম্পর্কে মন্ত্রী বলেন, ঢাকা-মাওয়া অংশের ৮০ শতাংশ, মাওয়া-ভাঙ্গা অংশের ৯৬.৫০ শতাংশ এবং ভাঙ্গা-যশোর অংশের ৭৮ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ২০২৪ সালের জুন মাসে এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে। এই সময়ের মধ্যেই বাকি কাজ সম্পন্ন করা হবে।373352116_3491895337743042_3412754948080263731_n

এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খান, পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম, রেলপথ সচিব ড. হুমায়ুন কবীর, রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. কামরুল আহসান, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের পরিচালক আফজাল হোসেন, রেলপথ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।373351263_286723250735464_4471999931056414710_n

দ্বিতল পদ্মা সেতুর নিচে রেল এবং ওপরে গাড়ি চলাচলের জন্য নির্ধারিত। গত বছর ২৫ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সড়ক অংশের উদ্বোধন করেন। পরদিন ২৬ জুন থেকে সেতুর ওপর দিয়ে যান চলাচল শুরু হয়।

প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত রেললাইনের নির্মাণকাজ শুরু হয়। জিটুজি পদ্ধতিতে এ প্রকল্পে অর্থায়ন করছে চীন। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ২০২৪ সালের জুনে। রেল সংযোগের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা।