মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পথে ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর নানা দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তান এই দিনে ভারতের বিভিন্ন এলাকায় বিমান হামলা শুরু করে। জবাবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারত ও বাংলাদেশ মিলে পাল্টা বিমান হামলা চালানো শুরু করে। ফলে সর্বাত্মক রূপ লাভ করে মুক্তিযুদ্ধ। ভারতীয় পূর্বাঞ্চল কমান্ডের লে জে জগজিৎ সিং অরোরার অধিনায়কত্বে ঘোষিত হয় বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ড। আর ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনী এবং বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে গঠিত হয় মিত্রবাহিনী।
এদিন থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের সহযোগিতা বাড়তে থাকে। ভারতের মিত্রবাহিনী আর মুক্তিযোদ্ধাদের মিলিত প্রতিরোধের মুখে একে একে পরাস্ত হতে থাকে হানাদাররা। মুক্তিবাহিনীর মনোবল আর প্রতিজ্ঞা বিজয় অর্জনের পথে সব বাধা অতিক্রম করে এগোতে থাকে। মাসের শুরু থেকেই যুদ্ধে লিপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ঝুলিতে জমতে থাকে একেকটি সাফল্যের গল্প। ছাত্র-শিক্ষক, শিল্পী-লেখক, মজুর-কৃষক, সেনা সবাই রুখে দাঁড়ান একাত্তরের দখলদার পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে।
এসময় যুদ্ধের কৌশলেও কিছু পরিবর্তন আনতে হয়। যৌথবাহিনী ঘোষণার পর বীর মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা আক্রমণ ছেড়ে মিত্রবাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়ে যৌথভাবে হানাদার পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ভারতীয় সেনাবাহিনী এতদিন সীমান্তে প্রকাশ্যে ঘোষণা ছাড়া ভেতরে ভেতরে মুক্তিবাহিনীকে সমর্থন দিয়েছিল। এসময়ে এসে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে একাকার হয়ে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘এই যুদ্ধকাল দীর্ঘ হবে না— এটুকু যেমন বোঝা যাচ্ছিল, ঠিক তেমন অনেক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি যে হবে; তাও স্পষ্ট হচ্ছিল। এদিকে পাকিস্তানি বাহিনীও সহিংস হয়ে উঠছিল। গণহত্যার যে মৌখিক দলিল পাওয়া যায়, তাতে করে এসময়ে দিশেহারা হয়ে ক্ষয়ক্ষতি কত বাড়িয়ে দেওয়া যায়, সেই পরিকল্পনা ছিল এবং সে অনুযায়ী বাস্তবায়নও চলছিল। তাদের দিশেহারা হওয়ার অন্যতম কারণ ৩ তারিখে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ অবস্থান।’
এদিন পাকিস্তান বাহিনীর সাবমেরিন ‘গাজীকে’ বঙ্গোপসাগরে ডুবিয়ে দেয় মিত্রবাহিনী। দিনাজপুর জেলার আরও কয়েকটি থানা মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ভারতীয় নৌবাহিনী বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী সমস্ত পাক অধিকৃত বন্দর অবরোধ করে জলপথে সরবরাহ ব্যবস্থা বন্ধ করে দেয়।
৩ ডিসেম্বর কুমিল্লায় মিয়াবাজারে পাকসেনাদের ওপর হামলা চালিয়ে দখল করে নেয় ক্যাপ্টেন আইন উদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী। এই ক্যাপ্টেন আয়েন উদ্দিনই বাঞ্ছারামপুরের ৫০ জনের একটি গেরিলা গ্রুপকে আগরতলার মনতলা ক্যাম্প থেকে বাংলাদেশে পাঠিয়েছিলেন এবং এই গ্রুপের পাঁচ জন শহীদ হয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধারা বলেন, অবশ্যই যে সময়ের প্রতিটা মুহূর্ত টান টান উত্তেজনার। কেননা তারা সামনে ঘটতে চলেছে এমন অনেক কিছু আঁচ করতে পারছিলেন। পরবর্তী সময়ে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে তারা প্রমাণ করেন যে তাদের আন্দাজ ঠিক ছিল।