মুক্তিযুদ্ধকালে দেশবাসীর প্রতি ছিল যেসব নির্দেশনা

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলার মানুষের কী করণীয়, মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা ও বিরোধী শক্তিকে মোকাবিলায় কী ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে—সেসব নিয়ে কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। চার নম্বর সেক্টরের দলিলপত্র থেকে এই প্রচারপত্র পাওয়া যায়।

প্রচারপত্রটি যুদ্ধ শুরুর তিন মাসের মধ্যে দেওয়া হয়। এর মূল লক্ষ্য ছিল—হানাদার বাহিনীর প্রতি পদক্ষেপ ও দুর্বার গণপ্রতিরোধ অধিকতর দৃঢ় করা। নির্দেশনায় বলা হয়, ‘নিকটস্থ মুক্তিবাহিনীর শিবির ও স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের কার্যালয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও পরিপূর্ণ সহযোগিতা বজায় রেখে চলুন এবং দুর্বার গতিতে মুক্তি সংগ্রামকে চূড়ান্ত বিজয়ের লক্ষ্যে পৌঁছে দিন।’

স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রের ১১তম খণ্ডে সন্নিবেশিত এই নির্দেশপত্রে লেখা—গ্রামের মণ্ডল/মোড়ল/মাতব্বর এবং অন্যান্য সবার প্রতি নির্দেশাবলি। নির্দেশের মধ্যে ছিল—‘স্বাধীন সার্বভৌম গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ সরকারের আদেশ ও নির্দেশাবলি মেনে চলুন এবং গ্রামবাসী সবাইকে মানতে অনুরোধ করুন। জঙ্গি ইয়াহিয়া সরকারের প্রশাসনিক ব্যবস্থা পূরণ প্রতিষ্ঠার সব প্রচেষ্টাকে বানচাল করুন। মুক্তিফৌজকে সর্বপ্রকার সাহায্য করুন। কারণ, তারা আপনার স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিয়ে সংগ্রাম করে যাচ্ছে। তারা আপনার সংগ্রামী ভাই, এটা আপনার নৈতিক কর্তব্য। পাক বাহিনীকে সব প্রকার সাহায্য থেকে বঞ্চিত করুন। আপনারা নিজ নিজ বুদ্ধি দ্বারা তাদের ক্ষতি করুন।’

নির্দেশে আরও বলা হয়, ‘‘স্বাধীনতা সংগ্রামের কোনও আপস নাই, কষ্ট আমাদের করতে হবে। ‘রক্ত যখন দিতে হবে শিখেছি, তখন আরও দেবো, দেশকে স্বাধীন করবো, ইনশাআল্লাহ।’ পাক সেনাবাহিনীর তাবেদাররা হুঁশিয়ার। তাদেরকে একে একে মুক্তিফৌজ সমূলে বিনাশ করবে। আপনারা এগিয়ে আসুন ও বিশ্বাসঘাতকদের চরম শিক্ষা দিন। বিশ্বাসঘাতকদের থেকে হুঁশিয়ার থাকুন। তারা আপনাদের মধ্যে ছড়িয়ে আছে। মুক্তিফৌজের গোপনীয়তা রক্ষা করুন। আপনার ক্ষুদ্র একটা ভুল অনেক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র শুনুন। এটাই বাঙালির মুখপত্র। শত্রুর মিথ্যা প্রচারণায় বিভ্রান্ত হবেন না। সত্য, ন্যায় ও স্বাধীনতার সংগ্রাম সর্বদা জয়যুক্ত হয়।’’

দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেলো বাংলাদেশ

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ৬ ডিসেম্বর দিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এদিন বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে ভারত প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়। লোকসভার অধিবেশনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতিদানের ঘোষণা দেন। এ সময় লোকসভার সদস্যরা দাঁড়িয়ে ইন্দিরা গান্ধীর ঘোষণাকে স্বাগত জানান। একইসঙ্গে লোকসভার অধিবেশনে হর্ষধ্বনির সঙ্গে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান উচ্চারিত হয়। ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার কিছুক্ষণ পরেই প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এক তারবার্তায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানান। সৈয়দ নজরুল ইসলাম তারবার্তায় বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণ ও বাংলাদেশ সরকার ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও অভিবাদন জানাচ্ছে। তার এই বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত আমাদের বিজয়ের পথে অনেকখানি পথ ধাবিত করলো। ভারত সরকার বাংলাদেশের ন্যায়সঙ্গত মুক্তি সংগ্রামে সমর্থন করায় বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের মধ্যে বন্ধুত্ব, শান্তি ও সহযোগিতার নতুন দ্বার উন্মোচিত হলো।’

স্বাধীনতার দলিলপত্রে ৬ ডিসেম্বর

ডিসেম্বরের শুরু থেকে একে একে হানাদারমুক্ত হতে থাকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল। ৬ ডিসেম্বর ফেনী, যশোর, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ, কুড়িগ্রাম, সুনামগঞ্জ ও লালমনিরহাট হানাদারমুক্ত হয়। এদিন যশোরে থাকা পাকিস্তানি নবম ডিভিশনের সৈন্যরা যশোর ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে মাগুরার দিকে পালিয়ে গেলে হানাদারমুক্ত হয় যশোর। ৬ ডিসেম্বর মেহেরপুর শহরও মুক্ত হয়। এর আগের দিন ভারতের তেহট্ট ক্যাম্প থেকে মেহেরপুরে অপারেশনের জন্য ৫১ জন মুক্তিযোদ্ধা মুজিবনগরের দারিয়াপুর হয়ে কোলা গ্রামে পৌঁছান। এরপর মুক্তিযোদ্ধাদের অবিরাম গুলিবর্ষণের পাল্টা গুলি চালাতে থাকে হানাদার বাহিনী। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়াবহ আক্রমণে পালায় পাক হানাদার বাহিনী। ৬ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ নিয়াজি এক নির্দেশে ঝিনাইদহ অবস্থান থেকে সরে এসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে ঢাকা রক্ষার নির্দেশ দেন। এদিন সুনামগঞ্জ ও ছাতক শহর হানাদারমুক্ত হয়।