গেরিলাযোদ্ধার চিঠি: যেভাবে শত্রু মোকাবিলা করা হতো

১৯৭১ সালে যুদ্ধ পরিস্থিতি সম্পর্কে এক গেরিলাযোদ্ধার চিঠিতে লেখা ছিল—যুদ্ধকালে কীভাবে তারা শত্রু মোকাবিলা করতো। শ্রীনগর গেরিলাকেন্দ্রের কমান্ডিং অফিসারকে লেখা চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেছেন, জুলাই থেকে দেশে ঢুকে কীভাবে হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের চিনে নিয়ে খতম করার অভিজ্ঞতা হয় তাদের। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রে সেই চিঠি নথিভুক্ত হয়ে আছে।

চিঠিতে তিনি লেখেন, ‘আমি (সি-২৫৬) ও অন্য একজন গেরিলা (সি-২৫৭) গত মাসে শ্রীনগর ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে গেরিলাযুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে জুলাই মাসে দেশে ফিরি। আমরা জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে আমাদের ওপর অর্পিত কার্যাদি সম্পন্ন করতে থাকি। এসব কার্যাবলির মধ্যে আছে— হানাদার সৈন্যের ওপর গ্রেনেড আক্রমণ, পাকবাহিনীর দালাল খতম, নতুন গেরিলা সৃষ্টি।’

পাঞ্জাবি হানাদার বাহিনী খতম

তিনি আরও লিখেছেন, ‘‘আমাদের গেরিলা অঞ্চল হলো ঢাকা জেলার মনোহরদী থানার পূর্বাঞ্চল ও ময়মনসিংহ জেলার কটিয়াদী থানার কোতোয়ালি অঞ্চল। এ অঞ্চলের ওপর দিয়ে মাঝে মাঝে পাক হানাদার বাহিনীর সামরিক কলাম (গাড়ির বহর) চলাচল করতো। আমরা দেশে ফেরার পর থেকেই তাদের ওপর আক্রমণ করার পরিকল্পনা করতে থাকি। তারা মিঞাদের (সি-২৫৭) বাড়ির কাছে নতুন একটি বাজার আছে, জনসাধারণ একে ‘জয় বাংলা বাজার’ নামে ডাকে। জুলাই মাসের ২১ তারিখে ১০১ জন পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্য ও কিছু বাঙালি দালাল ও বন্দি ইপিআরসহ হানাদার বাহিনীর ১৬০ জনের মতো লোক এই বাজারে হানা দেয়। হানাদার বাহিনী সকাল ৭টার সময় পৌঁছে সারা দিন কিছু লুটপাট করার পর তারা সন্ধ্যার সময় খাবার রান্না করতে থাকে। চারদিকে পাহারা বসিয়ে তারা নিশ্চিত মনে ঘোরাফেরা ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজকর্মে ব্যস্ত থাকে। আমি (সি-২৫৬) ও তারা মিঞা (সি-২৫৭) সারা দিন থেকেই তাদের আক্রমণ করার জন্য ঘুরতে থাকি। সন্ধ্যা ৭টার সময় অতি কষ্টে আমরা হানাদার বাহিনীর ৫০ গজের মধ্যে পৌঁছি। কিন্তু তাদের সুবিধামতো পাওয়া যায় না। আবার রাত্র ৯টার দিকে তারা মিঞা (সি-২৫৭) ও আমি (সি-২৫৬) তাদের কাছে পৌঁছি। প্রথম তারা মিঞা তাদের ওপর গ্রেনেড চার্জ করে। সঙ্গে সঙ্গে আমি ও তারা মিঞা মোট চারবার তাদের ওপর গ্রেনেড চার্জ করি। গ্রেনেড চার্জ করার পর আমরা সেখান থেকে ভালোভাবেই রিট্রিট করি। রাতেই দস্যুরা গ্রামে আগুন দিতে থাকে। সকালের দিকে তারা মিঞাদের (সি-২৫৭) বাড়ি, তাদের আত্মীয়-স্বজন ও চরমান্দালিয়া গ্রামের অন্যান্য লোকজনের বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। গ্রামের লোকজন সবাই অন্যদিকে সরে পড়ে, দুই জন তাদের হাতে নিহত হয়। পরে লোকজনের কাছ থেকে আমরা জানতে পারি, হানাদার সৈন্যদের ২ জন নিহত ও ১০-১২ জন আহত হয়। কাছে দালাল থাকায় ও বাজারে ঘর থাকায় এবং সৈন্যরা প্রথম আক্রমণের পর পজিশন নিয়ে ফেলায় তাদের ক্ষতি কম হয়।’’

পাক বাহিনীর দালাল খতম

গেরিলাযোদ্ধা চিঠিতে আরও লিখেছেন, ‘‘পাক সামরিক বাহিনী গ্রাম থেকে চলে যাওয়ার পর আমাদের গোয়েন্দা বাহিনী অনুসন্ধান করে জানতে পারে যে তারা মিঞার (সি-২৫৭) গ্রামে (চরমান্দালিয়া) দস্যুদের আনার ব্যাপারে মনোহরদী থানার চরমান্দালিয়া ইউনিয়নের খালিয়াবাদ গ্রামের মোশারফ হোসেনের হাত আছে। মোশারফ হোসেন অত্র অঞ্চলে মুসলিম লীগের একজন নেতা ছিল। সে পূর্ব বাংলার প্রতারকদের মধ্যে অন্যতম। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জেলায় কখনও মিলিটারি, কখনও ইন্সপেক্টর, কখনও দারোগা—প্রভৃতি সেজে বহু লোকের কাছ থেকে বহু টাকাপয়সা প্রতারণা করে জোগাড় করেছে। এ অঞ্চলে গত ইলেকশনের সময় সে প্রগতিশীল ও স্বাধীনতাকর্মীদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালিয়েছিল। চরমান্দালিয়া গ্রাম পোড়ানোর পর সে লোকজনকে বলে—‘শালাদের ঠান্ডা করেছি। এবার তোরা মুসলিম লীগ জিন্দাবাদ, পাকিস্তান জিন্দাবাদ বল, নইলে তোদেরও খতম করবো।’ এসব শোনার পর ও তার পূর্ব কার্যকলাপের দরুণ আমরা তাকে খতম করার সিদ্ধান্ত নিই। আমি এবং এই গ্রামের অন্যান্য যুবক মিলে গত ২৩শে জুলাই শুক্রবার রাতে তাকে খতম করে দেই। মোশারফ দালালকে খতম করার পর আমাদের অঞ্চল সম্পূর্ণরূপে পাক দালালমুক্ত হয়েছে।’’

নতুন গেরিলা সৃষ্টি

তার চিঠির ভাষ্যমতে—‘আমরা জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক প্রচারণা চালিয়ে গ্রামের প্রায় ৫০ জনের মতো লোককে মানসিকভাবে গেরিলাযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেছি। তারা মিঞার (সি-২৫৭) সঙ্গে কিছু লোককে ভারতে পাঠাচ্ছি। তারা এ মাসেই ভারতে পৌঁছাবে ও বিভিন্ন ক্যাম্পে গেরিলাযুদ্ধের ট্রেনিং নেবে।’

‘আমরা এখন অস্ত্র সংকটে ভুগছি। আমাদের গ্রেনেড শেষ হয়ে গেছে। পাক বাহিনী সংখ্যার দিক থেকে বেশি হওয়ায় আমরা তাদের ক্ষতিসাধন করলেও তাদের কাছ থেকে কোনও অস্ত্র উদ্ধার করতে পারিনি। আমরা এখন নিরস্ত্র অবস্থায় আছি। তারা মিঞা (সি-২৫৭) আরও অস্ত্রের জন্য ভারতে আসছে। আপনি দয়া করে আমাদের দুই জনকে দুটি অটোমেটিক হাতিয়ার দিয়ে দেবেন। আমরা আমাদের সম্পূর্ণ শক্তি দিয়ে পাক বাহিনীর ও তার দালালদের প্রতিরোধ করবো।’

এসব চিঠি প্রামাণ্য দলিল উল্লেখ করে ইতিহাসবিদ মুনতাসির মামুন বলেন, ‘আমাদের সংরক্ষণে যা আছে তা যদি পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তাহলে তারা বাংলাদেশকে চিনতে পারবে, এ দেশকে ভালোবাসবে। আমাদের সবার দায়িত্ব কাজটি সম্পাদন করে যাওয়া।’