১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পশ্চিম পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর হাতে আটক ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৬ ডিসেম্বর দেশ যখন বিজয়ের গান গাইছে তখনও তিনি বন্দি। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি স্বাধীন দেশের মাটিতে ফিরে আসেন। সেই আসাও খুব সহজ পথে ছিল না। কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ৮ জানুয়ারি যখন জানা গেলো—তিনি লন্ডনের পথে, তখন স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে সেই খবর। সেই রাতে যখন বঙ্গবন্ধু তাঁর পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন তখন মানুষ জানতে পারেন– এক মুহূর্তও দেশ, দেশের মানুষ ও পরিবার ছেড়ে তিনি বাইরে থাকতে রাজি নন। তিনি ফিরছেন।
রাওয়ালপিন্ডি ত্যাগের ১০ ঘণ্টা পর হিথ্রো পৌঁছান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেখানে অবস্থিত বাঙালিরা একনজর তাঁকে দেখার জন্য ভিড় করেন বিমানবন্দরে, হোটেলের সামনে, রাস্তায়। ততক্ষণে ঢাকায় খবর পৌঁছে গেছে। সবার মনে একই প্রশ্ন– কখন আসবেন বঙ্গবন্ধু। এরইমধ্যে জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনতে বিস্তারিত পরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্দেশ্যে ৮ জানুয়ারি বঙ্গভবনে মন্ত্রিসভার বিশেষ বৈঠক বসে। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এতে সভাপতিত্ব করেন। বৈঠকে বঙ্গবন্ধুকে দেশে আনার পরিকল্পনা ও কর্মসূচি আলোচিত হয়। সেখানে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ জানান, বঙ্গবন্ধু ফেরার পথে ভারতের ওপর দিয়ে আসবেন। এদিনই সাংবাদিকদের জানানো হয়— বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৪ থেকে ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে বাংলাদেশে ফিরবেন।
মা-বাবার কাছেও খবরটি ছিল অবিশ্বাস্য !
পাকিস্তানের জেল থেকে বঙ্গবন্ধু ছাড়া পেয়েছেন, তিনি এখন মুক্ত এবং সুস্থ এ কথা বঙ্গবন্ধুর পিতামাতা বিশ্বাসই করেননি! অনেক বোঝানোর ও বলা-কওয়ার পর তারা খবরটা বিশ্বাস করেন। ঢাকা শহর আওয়ামী লীগের সম্পাদক গাজী গোলাম মোস্তফা এমপিএ ৮ জানুয়ারি এ কথা জানান।
দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত ৯ জানুয়ারির খবরে লেখা হয়—শেখ রেহানাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল কী আলাপ হলো। লজ্জাবিধুর কণ্ঠে রেহানা জানালেন, আব্বা বললেন, ‘কী মা, কেমন আছো?’ ব্যাস, আর কিছু শুনিনি আমি। বঙ্গবন্ধুর ছোট ছেলে রাসেল তখন খেলছিল আপন মনে। ওকে দেখে মনে হচ্ছিল—খুব খুশি সে আজ। আব্বা আসছে। শেখ রেহানা জানান, ‘রাসেলও কথা বলেছে ফোনে। রাসেল আমাকে বললো, সে ঠিকই আব্বার গলা চিনতে পেয়েছে।’
ফোন ধরেছিলেন বেগম মুজিবুর রহমানও। কিন্তু, ফোনে কথা বলতে পারেননি। শুধু, বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠস্বরটাই শুনতে পেয়েছেন তিনি। আজকে জাতির এই শুভ মুহূর্তে বেগম মুজিব কিছু বলবেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলছিলেন, শেখ সাহেব না আসা পর্যন্ত তিনি কিছুই বলবেন না। এ সময় অলইন্ডিয়া টেলিভিশন একটা প্রামাণ্য অনুষ্ঠানের চিত্র তুলছিল। শেখ হাসিনার ছোট্ট ছেলেটি একবার কেঁদে উঠলে তাকে প্রবোধ দিতে শোনা যায়—‘না না কাঁদে না, নানা আসবে, নানা আসবে’। সে তখনও নানাকে দেখেনি।
মুক্তিযুদ্ধকালে লন্ডনে থেকে আন্তর্জাতিক পরিসরে যুদ্ধ, শরণার্থী, সহায়তা নিয়ে কাজ করেছিলেন বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। বঙ্গবন্ধু মুক্ত হয়ে সরাসরি লন্ডন আসছেন জানার পরে কেমন ছিল সেখানকার আবহ, বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু লন্ডনে নামার পর থেকে তাঁর নিরাপত্তা ইস্যুটি বড় হয়ে দেখা দেয়। বঙ্গবন্ধু এসেছেন শুনে হোটেলের বাইরে শত শত মানুষ উপস্থিত হয়েছিল। যারাই সেখানে বসবাস করতেন, তাদের আবেগ কাজ করছিল প্রচণ্ড। আমরা কয়েকজন ভেতরে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। এবং নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু তখনই যে বিশ্বনেতৃত্বের কাছে ‘ম্যাটার করছিলেন’ সেটা আমরা নিজ চোখে সেদিনই দেখেছিলাম।’