মিয়ানমারের সঙ্গে দেড় হাজার কিলোমিটারেরও বেশি দীর্ঘ সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া বসানোর ঘোষণা দিয়েছে ভারত। তবে এমন কোনও পদক্ষেপের কথা এই মুহূর্তে ভাবছে না বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ দিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ও দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সঙ্গে বৈঠকে বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন বলে জানতে পেরেছে বাংলা ট্রিবিউন। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, মিয়ানমারের সঙ্গে অনেক সীমানা নদীপথের। তাই কাঁটাতারের বেড়া ভারতের কাজে লাগলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেটা না-ও হতে পারে।
মিয়ানমারে অভ্যন্তরীণ সংঘাতের জেরে গত সপ্তাহখানেকের মধ্যে তুমব্রু ও ঘুমধুম সীমান্ত এলাকা দিয়ে দেশটির সেনাবাহিনী, সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপিসহ বিভিন্ন বাহিনীর দুই শতাধিক সদস্য বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন। রাখাইন প্রদেশে বিদ্রোহীদের সঙ্গে সংঘাতের জেরেই তারা বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছেন।
এর আগে গত জানুয়ারি মাস থেকে ঠিক একইভাবে ভারতেও মিয়ানমারের ৬ শতাধিক সৈন্য আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের বেশিরভাগই সীমান্ত লাগোয়া মিজোরামের লংতলাই জেলা দিয়ে অনুপ্রবেশ করেন। এরও তিন বছর আগে মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের পর সে দেশের চিন রাজ্য থেকে ৪০ হাজারেরও বেশি শরণার্থী মিজোরামে আশ্রয় নিয়েছেন।
এরই প্রেক্ষাপটে কিছু দিন আগে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ঘোষণা করেন, মিয়ানমারের সঙ্গে ভারতের যে দীর্ঘ ১ হাজার ৬৪৩ কিলোমিটার লম্বা সীমান্ত আছে, তার পুরোটাজুড়েই কাঁটাতারের বেড়া বসানো হবে।
এই মুহূর্তে ভারত ও মিয়ানমারের মধ্যে একটি ‘ফ্রি মুভমেন্ট রেজিম (এফএমআর)’ চালু আছে, যার আওতায় দুই দেশের নাগরিকরা একে অন্যের দেশে সীমান্ত থেকে ১৬ কিলোমিটার পর্যন্ত বিনা ভিসায় ও অবাধে চলাফেরা করতে পারেন। কাঁটাতারের বেড়া বসানো হলে সেই এফএমআরের কার্যত অবসান ঘটবে।
গত বুধবার (৭ ফেব্রুয়ারি) দিল্লিতে অজিত দোভাল ও এস জয়শঙ্করের সঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পৃথক বৈঠকেও মিয়ানমারের সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে সংগত কারণেই বিশদে আলোচনা হয়েছে। জানা যাচ্ছে, পরিস্থিতি সামলাতে বাংলাদেশও মিয়ানমারের সঙ্গে তাদের সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া বসানোর কথা বিবেচনা করতে পারে—ভারতের পক্ষ থেকে বৈঠকে এমন প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু সেখানে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়ে দেন, মিয়ানমার সীমান্তের সংকট সামাল দিতে তারা ভারতের সঙ্গে একটি ‘সুসমন্বিত কর্মপরিকল্পনা’ (কোঅর্ডিনেটেড অ্যাকশন প্ল্যান) নিয়ে এগোতে চান ঠিকই, কিন্তু এখনই মিয়ানমার সীমান্তে বেড়া বসানোর কথা ভাবছে না বাংলাদেশ।
পরদিন (৮ ফেব্রুয়ারি) দিল্লির থিংকট্যাংক ‘বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের’ এক প্রশ্নোত্তর পর্বেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদকে একই প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। সেখানে তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, ভারতের মতো বাংলাদেশও কি মিয়ানমার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া বসানোর কথা ভাবছে?
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই প্রশ্নের সরাসরি জবাব এড়িয়ে গিয়ে বলেন, ‘ভারত যে কাঁটাতারের বেড়া বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটাতে নিশ্চয় তাদের (ভারত) জন্য ভালো হবে। হয়তো এই পুরো অঞ্চলের জন্যই তাতে ভালো হবে।‘
‘আমরা জানি মিয়ানমার সীমান্তে জঙ্গিবাদের সমস্যা দীর্ঘদিন ধরেই রয়েছে। তার জেরে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে সে দেশের নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর শত শত সদস্য পালিয়েও এসেছেন। আমি যতটুকু বুঝেছি তাতে ওই কারণেই ভারত এই বেড়া বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং এটা নিশ্চয় তাদের জন্য একটা কার্যকরী পদক্ষেপ হবে’, বলেন তিনি।
ড. হাছান মাহমুদের কথাতেই স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল যে ভারতের জন্য যেটা কার্যকরী পদক্ষেপ—বাংলাদেশের জন্যও সেটা একইরকম ফলপ্রসূ না-ও হতে পারে। বস্তুত বাংলাদেশ সরকার কেন মিয়ানমার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া বসাতে চাইছে না, তার কতগুলো নির্দিষ্ট কারণও আছে। ভারতের কাছে সেগুলো তারা কিছুটা তুলেও ধরেছেন।
বাংলাদেশের কূটনৈতিক সূত্রগুলো এই সিদ্ধান্তের পক্ষে যে কারণগুলো দেখাচ্ছেন, তা মোটামুটি এরকম—
প্রথমত, কাঁটাতারের বেড়া বসানো একটি সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া। বেড়া বসানোর সিদ্ধান্ত যদি নেওয়াও হয়, তারপরও সে কাজ শেষ হতে অন্তত বছর তিনেক সময় লাগবে। ফলে এই মুহূর্তে যে সংকট চলছে, সেটা মোকাবিলায় তা কোনও কাজে আসবে না। তা ছাড়া এর একটা বড় আর্থিক অভিঘাতও (ফিন্যান্সিয়াল ইমপ্লিকেশন) আছে। সীমান্তে বেড়া বসানোর জন্য বাংলাদেশ সরকারকেই অর্থের সংস্থান করতে হবে। কোনও উন্নয়ন সহযোগী বা ঋণদাতা সংস্থাও এ জন্য অর্থ দেবে না।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে যে ২৭১ কিলোমিটার দীর্ঘ আন্তর্জাতিক সীমান্ত রয়েছে, তার মধ্যে প্রায় এক-চতুর্থাংশই নদীপথ। মানে ওই সীমান্তের মধ্যে ৬৪ কিলোমিটার ধরে দুই দেশের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া নাফ নদীটাই আন্তর্জাতিক সীমান্ত। যেখানে কোনও কাঁটাতারের বেড়া বসানো সম্ভবই নয়। ফলে সীমান্তের অন্যত্র বেড়া বসানো হলেও নদীপথে সীমান্ত পারাপার বন্ধ করা একরকম অসম্ভব। সুতরাং বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া আদৌ সেরকম কার্যকর হবে না।
তৃতীয়ত, মিয়ানমার থেকে আসা লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়ার ফলে আন্তর্জাতিক বিশ্বে বাংলাদেশের একটা উজ্জ্বল ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছে, বহু দেশ ও দাতা সংস্থা বাংলাদেশকে এ জন্য সাহায্যের হাতও বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন সেই মিয়ানমার সীমান্তেই বাংলাদেশ যদি বেড়া বসাতে যায়, সেটার একটা বিরূপ প্রভাব তৈরি হতে পারে।
প্রসঙ্গত, মেক্সিকো সীমান্তে যখন আমেরিকার ট্রাম্প প্রশাসন দেয়াল তোলার কাজ শুরু করেছিল কিংবা ইসরায়েল যখন পশ্চিম তীরের সীমান্তকে উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘিরে দেয়—আন্তর্জাতিক বিশ্বে তার কম সমালোচনা হয়নি। এমনকি, বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতের কাঁটাতারের বেড়া বসানোটাও ছিল একটি বিতর্কিত সিদ্ধান্ত। এখন বাংলাদেশ নিজেরাও অন্য দেশের সঙ্গে তাদের সীমান্তে একই পথে হাঁটবে, এটা অবশ্যই কাঙ্ক্ষিত নয়।
তা ছাড়া, মিয়ানমার সীমান্তে বাংলাদেশ যদি একতরফা বেড়া বসাতে চায়, তাহলে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর জন্য প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াও ব্যাহত হতে পারে বলে কোনও কোনও পর্যবেক্ষক মনে করেন। এই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে প্রধান অগ্রাধিকারগুলোর মধ্যে পড়ে। কাজেই সরকার অবশ্যই নিশ্চিত করতে চাইবে সেই প্রচেষ্টা যাতে কোনও ঝুঁকির মুখে না পড়ে।