রাষ্ট্রভাষা বাংলাকে সব ক্ষেত্রে ব্যবহারের তাগিদ সর্বসাধারণের

বাংলার, বাঙালির মাতৃভাষা বাংলা। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা রাষ্ট্রভাষা হবে—এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার অপচেষ্টা করে তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকরা। বাঙালি বুকের তাজা রক্তের স্রোত বইয়ে সেই ষড়যন্ত্র রুখে দেয় ১৯৫২ সালে। ভাষা আন্দোলনের হাত ধরে দানা বাঁধে বাংলার মুক্তির সংগ্রাম। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পায় বাংলা। কিন্তু ৫০ বছরের বেশি পার হলেও এখনও রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। অমর একুশে ফেব্রুয়ারি মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে সর্বসাধারণের সেই দাবিই সামনে এলো।

মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলন সূচনা হয় চল্লিশের দশকে, যা চূড়ান্ত রূপ লাভ করে পঞ্চাশের দশকে। 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' স্লোগানে রাজপথে ফেটে পড়ে বাঙালিরা। ছাত্রসমাজ অগ্রণী ভূমিকায় থাকায় ১৪৪ ধারা ভেঙে বুক পেতে দিয়েছিল বন্দুকের নলের সামনে। পুলিশের গুলি নিহত হন সালাম, বরকত, রফিক ও জব্বারসহ অনেকে।

ওই হত্যার প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ ঢাকাবাসী ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলে সমবেত হয়, পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি আবারও রাজপথে নেমে আসে ছাত্রসমাজসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। ভাষা শহীদদের স্মৃতিকে অমর করে রাখতে ২৩ ফেব্রুয়ারি এক রাতের মধ্যে মেডিক্যাল কলেজের হোস্টেল প্রাঙ্গণে গড়ে ওঠে একটি স্মৃতিস্তম্ভ। এরপর একাধিকবার গুঁড়িয়ে ফেলা হয়েছে সেই বেদি। আবারও মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে ভাষা শহীদদের স্মৃতি। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করলে ৯ মে গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সেই থেকে আমাদের মুখের ভাষা, কাগজে-কলমে আমারই ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায় আ-মরি বাংলা ভাষা।

মাতৃভাষা, রাষ্ট্রভাষার জন্য এমন জীবনদান, আত্মত্যাগের ঘটনা বিরল হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নেয়। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯৯৭ সাল থেকে দেশে-দেশে বিশ্বব্যাপী উদযাপন হয়ে আসছে দিবসটি। এই দিবস উদযাপনে যখন প্রস্তুত করা হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, তখন বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে চলছে অমর একুশে গ্রন্থমালা।

একুশে ফেব্রুয়ারি মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করছে বাংলাদেশ। মাতৃভাষা আন্দোলনের ৭২ বছর পূর্ণ হলো আজ বুধবার (২১ ফেব্রুয়ারি)। এমন প্রেক্ষাপটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী আবুল হাসান বলেন, বাংলা রাষ্ট্রভাষা হলেও এখনও রাষ্ট্র ও সমাজের সব ক্ষেত্রে এর ব্যবহার নিশ্চিত হয়নি। অফিস-আদালত থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আজও ইংরেজি ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলা ভাষা বিশ্বদরবারে মর্যাদা পেলেও আমরা এই ত্যাগের মাতৃভাষার যথাযথ মর্যাদা দিতে পেরেছি কিনা, সে নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক।

দেখা যায়, আজও আইনি আদেশ বা রায়ের ক্ষেত্রে, চিকিৎসা সেবায়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামকরণে, মুঠোফোনে ইংরেজিই অগ্রাধিকার পাচ্ছে। এমন অবস্থার মধ্যেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকে কয়েক বছর ধরে বাংলাকে জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষা করার বিষয়টি সামনে আনা হয়েছে। ২০২১ সালে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা এ কে আব্দুল মোমেন বলেছিলেন, দাফতরিক ভাষা হিসেবে বাংলা চালু করার প্রস্তাবে কোনও সদস্য রাষ্ট্রের বিরোধিতা না থাকলেও অর্থের জন্য জাতিসংঘের পক্ষে এটি চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, গত কয়েক বছর ধরে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো কার্যক্রমের প্রস্তাবনা নিয়ে কাজ করছে। জাতিসংঘের বৃহত্তম পুনর্গঠন যখন হবে, তখন আমরা আমাদের বিষয়টি তুলে ধরবো।

এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের নতুন সরকারের পক্ষ থেকে অগ্রগতি জানা না গেলেও একুশের বইমেলায় আসা কয়েকজন বলছেন, বাংলাদেশের সব ক্ষেত্রে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করতে তো আর টাকার প্রয়োজন হয় না। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে এটি করা অসম্ভব নয়। সরকার বিষয়টিতে আরও গুরুত্ব দেবে বলে আশা করেন তারা।

এমন অভিমত দেওয়া রাসেল আহমেদ কাজ করেন একটি বেসরকারি ব্যাংকে। তিনি বলেন, বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, রাষ্ট্রভাষা। ব্যাংকে বাংলার চেয়ে ইংরেজির ব্যবহার বেশি। অথচ হওয়ার কথা ছিল উল্টোটা। আমরা ৫০ বছরের বেশি সময় পরও এটি করতে পারিনি। এটা বাঙালি হিসেবে আমাদের জন্য লজ্জার ও দুঃখজনক ঘটনা। বিষয়টি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের হওয়ায় সরকারকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে।

অ্যাডভোকেট আরিফুর রহমান বলেন, আমরা আদালতে বাংলায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে থাকি। কিন্তু আইনের বই এবং আগের রায়গুলো ইংরেজিতে। এখনকার রায়ের বেশিরভাগও ইংরেজিতে দেওয়া হয়। তবে কিছু কিছু রায় বাংলায় দেওয়া হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে। এটি আশার কথা হলেও সব রায় বাংলায় দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু জটিলতা থাকলেও অসম্ভব নয়।

একুশে ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটি। এদিন দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভবনে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সঠিক নিয়মে, সঠিক রঙ ও মাপে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত এবং কালো পতাকা উত্তোলন করা হবে। দিবসটি পালন উপলক্ষে জাতীয় অনুষ্ঠানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সব স্থানীয় সরকারি প্রতিষ্ঠান, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনগুলো বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।

দিনটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হলেও এসব প্রতিষ্ঠানের নানা ক্ষেত্রে বাংলা উপেক্ষা হয় বলে মনে করেন শিক্ষক আতিকুজ্জামান। সন্তানদের নিয়ে বইমেলায় আসা এই মানুষটি বলছেন, ভাষার শক্তিশালী ব্যবহার বোঝা যায় নথিপত্রের দিকে তাকালে। এসব নথি হাজার বছর সংরক্ষিত থাকে। সেখানে বেঁচে না থাকলে কেবল বইপুস্তকে বাংলা থাকলে এগোনো যাবে না। রাষ্ট্রের, সমাজের সব ক্ষেত্রে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। সেদিকে সংশ্লিষ্টদের মনোভাব দিতে হবে।

রাজধানী ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ এবং বিভিন্ন স্থানে আলোচনা সভাসহ নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে জাতি একুশের মহান শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবে আজ। রাত ১২টা ১ মিনিটে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে একুশের কর্মসূচি শুরু হচ্ছে। প্রথমে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। এছাড়া  কালো ব্যাজ ধারণ, প্রভাত ফেরিসহ আজিমপুর কবরস্থানে শহীদদের কবরে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ ও শ্রদ্ধা জানানো হবে।

বাংলা সাহিত্যের একনিষ্ঠ পাঠক আশফাকুল ইসলাম আমিনের ভাষ্য—প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি এলে ভাষা শহীদদের প্রতি আমরা শ্রদ্ধা জানাই। নানানভাবে আমরা দিবসটি পালন করি, উদযাপন করি। কিন্তু বাংলা ভাষার ব্যবহারের প্রতি সারা বছর সেভাবে আমরা যত্নবান নই৷ এ ব্যাপারে আমাদের আরও সচেতন হতে হবে, দায়িত্বশীল হতে হবে। তা না হলে কোনও কিছুই বাংলার ব্যবহারে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে না।

রিকশাচালক রহমত আলী বলেন, আমরা তো বাংলায়ই কথা কই। শিক্ষিত লোকজন বলে ইংরেজিতে। অফিস-আদালতে যান আর একটা হোটেলে (রেস্টুরেন্ট) যান, দেখবেন সবখানে ইংরেজি। আমরা ইংরেজি পড়তে পারি না। তাই ওইসব জায়গায় যাইও না।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে ১৯৮৭ সালের ৮ মার্চ ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন’প্রণয়ন করা হয়। এ আইনের ৩ ধারায় আইনটির প্রবর্তন ও কার্যকরী ব্যবস্থা সম্পর্কে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস, আদালত, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সওয়াল-জবাব এবং অন্যান্য আইনি কার্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে।