প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা কয়েকটি বিষয়ে আলোচনা করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল, নোবেলজয়ীর নেতৃত্বাধীন অন্তর্বতীকালীন সরকারকে ‘সময়’ দেওয়ার মধ্য দিয়ে সহযোগিতা করার প্রস্তাব। এ বিষয়ে প্রকাশ্যে বিএনপি-জামায়াতও কথা বলেছে। পাশাপাশি অধিকাংশ দলও কিছু দাবি-দাওয়া জানিয়েছে। এসময় ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস পরিবর্তনের বিষয়টি নিয়েও আকারে-ইঙ্গিতে কথা বলেছে কোনও-কোনও দল।
সোমবার (১২ আগস্ট) বিকাল চারটায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এরপর তিনি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ, গণঅধিকার পরিষদ (একাংশ), গণতন্ত্র মঞ্চের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেন।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, ফরিদা আখতার, আদিলুর রহমান খান, মোঃ নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।
ইসলামী আন্দোলনকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও মতবিনিময়ে অংশ নেয়নি দলটি। এ বিষয়ে সোমবার মধ্যরাতে দলের কেন্দ্রীয় একজন নেতা বলেন, ‘সোমবার যাইনি, মঙ্গলবার যাবো।’ তবে একটি দলের প্রভাবশালী একজন নেতা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা জামায়াতের একটি বড় প্রতিনিধি দলকে বেশি সময় দিয়েছেন। আর সেটি জানার পর ইসলামী আন্দোলন অনীহা প্রকাশ করে।’
প্রসঙ্গত, সোমবার আরও তিনটি দলের সঙ্গে ইসলামী আন্দোলনেরও মতবিনিময় সভায় অংশ নেওয়ার কথা ছিল।
সোমবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনায় নেতারা দলের পক্ষ থেকে প্রস্তাবনা তুলে ধরেন। লিখিত প্রস্তাবনা দেওয়া হয় ড. ইউনূসের হাতে। মতবিনিময়ে অংশ নেওয়া একাধিক দলের প্রধান নেতারা বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, ১৫ আগস্টকে শোক দিবস হিসেবে বাতিলের প্রস্তাব দিয়েছেন তারা।
বৈঠক থেকে বেরিয়ে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, ‘আমরা ১৫ আগস্টকে জাতীয় শোক দিবস করাসহ আওয়ামী লীগ সরকারের নেওয়া বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোর পর্যালোচনা করতে বলেছি। এটি (১৫ আগস্ট) শোকের নয়, বরং এটি আমাদের সুখের ও শান্তির মাস।’ এসময় তিনি ১৫ আগস্টের সরকারি ছুটি বাতিল করার আবেদন জানিয়েছেন বলেও জানান।
নোবেলজয়ী ড. ইউনূসের সঙ্গে মতবিনিময়ে, ১৫ আগস্টকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন না করার বিষয়টি বিবেচনা করার প্রস্তাব দেয় এবি পার্টি। দলটির নেতারা বৈঠক থেকে বেরিয়ে বলেন, কোনও গণপ্রজাতন্ত্রে ব্যক্তি কেন্দ্রীক দিবস বা সাধারণ ছুটি ঘোষণা অনুচিত। এটি মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রের পরিপন্থি। এবি পার্টি মনে করে জাতীয় ব্যক্তিত্বদের অবদান স্মরণ করার আনুসাঙ্গিক ব্যবস্থা থাকতে পারে তবে এই রাষ্ট্র কোনও একক ব্যক্তির অবদান নয়। কোন ব্যক্তিকে অতিমাত্রায় পূজনীয় আকারে হাজির করলে আদতে তার অসম্মান ও পতন অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়।’
এবি পার্টির প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে ছিলেন আহ্বায়ক এএফএম সুলাইমান চৌধুরী, সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু, যুগ্ম সদস্য সচিব ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ।
সোমবার রাতে এ বিষয়ে জানতে চাইলে মতবিনিময়ে অংশ নেওয়া একটি দলের অন্যতম প্রধান নেতা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মূলত ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস হিসেবে বাতিল করার চিন্তা অন্তবর্তীকালীন সরকারের। আর এ বিষয়টিই একাধিক রাজনৈতিক দল সামনে এনেছে। ধারণা করা হচ্ছে, আজকালের মধ্যে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে ১৫ আগস্ট বাতিল করা হবে।’
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার, আত্মীয়স্বজন হত্যাকাণ্ডের দিনটিকে জাতীয় শোক দিবস (১৫ আগস্ট) হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরে ২০০২ সালে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট তা বাতিল করে। ২০০৮ সালে হাইকোর্টের এক রায়ে ১৫ই অগাস্টকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পুর্নবহাল করা হয়।
প্রসঙ্গত, আগামী ১৫ আগস্ট (বৃহস্পতিবার) জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন করতে নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দিয়ে প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে আওয়ামী লীগ।
প্রধান উপদেষ্টাকে ‘সময়’ দিয়েছেন রাজনীতিকরা
ড. ইউনূসের সঙ্গে মতবিনিময়ের পর সাংবাদিকদের বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমরা নির্বাচন নিয়ে কথা বলিনি। নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে তাদের একটি নির্দিষ্ট সময় লাগবেই। আমরা সে সময় দিয়েছি।’ এসময় তিনি আরও বলেন, ‘দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে কী কী করা যায় এ বিষয়ে আমরা মতামত দিয়েছি। তারা কী কী পদক্ষেপ নিয়েছেন এবং আরও কী কী পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছেন সে বিষয়ে আমাদের অবগত করেছেন।’
তবে নির্বাচন দিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কতটা সময় লাগতে পারে এমন প্রশ্নের সরাসরি কোনও জবাব দেননি বিএনপিনেতারা। দলটির স্থায়ী কমিটির নেতাদের কেউই সুনির্দিষ্ট সময়ের বিষয়ে কথা বলতে আগ্রহী নন। এক নেতার ভাষ্যমতে, বর্তমান সরকারকে অন্তত দুই বছর সময় না দিয়ে নির্বাচন করা সঠিক হবে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সোমবার সন্ধ্যায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সেক্রেটারি জেনারেল যা বলেছেন, ওটাই। আমরা এর বেশি কিছু বলতে পারছি না।’
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে স্থায়ী কমিটির বৈঠক করে বিএনপি।
বিএনপির পর যমুনায় বৈঠকে অংশ নেয় জামায়াত। বৈঠক থেকে বেরিয়ে দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে কোনও কথা হয়নি। ওনারা কেবল বসলেন। মাত্র চারটা দিন হলো। ওনারা কীভাবে জাতিকে নিয়ে এগোতে চাচ্ছেন, সমস্যাগুলোর আশু সমাধান কীভাবে করেন আমরা তা দেখতে চাই। আমরা আশাবাদী, এগুলো যৌক্তিক সময়েই সমাধান হবে। দেশ আমাদের সবার।’
বৈঠকে জামায়াতে ইসলামীর আমিরের সঙ্গে আরও উপস্থিত ছিলেন নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের ও শামছুল ইসলাম, সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান, হামিদুর রহমান আযাদ ও এহসান মাহবুব যোবায়ের, মহানগর দক্ষিণের আমির নুরুল ইসলাম ও উত্তরের আমির সেলিম উদ্দিন।
এর আগে, সোমবার বিকালে বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে আলাপকালে বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, ‘তিন মাস, দুই মাস বা সাড়ে তিনমাসে তো সংস্কার আসবে না। নির্বাচন কমিশনও সংস্কার করতে হবে। প্রশাসনের সর্বস্তরে দলীয় লোকজন, এগুলো ঠিক করতে হবে। সময় লাগবে। আমরা সময় জানতে চাইবো।’
রাষ্ট্রব্যবস্থার রূপান্তরের দাবি
মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক থেকে বেরিয়ে গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘আমরা বৈঠকে আশু কয়েকটি বিষয়ে সমাধানের কথা বলেছি। সারাদেশে প্রশাসন ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা হয়েছে। ফলে জানমালের নিরাপত্তার যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে অবিলম্বে প্রশাসন ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দ্রুত পুনর্গঠন করতে হবে। কোনভাবেই ষড়যন্ত্রকারীরা, কথিত স্বৈরাচাররা যেভাবে চক্রান্ত করছে, তারা যেন করতে না পারে। আর সেজন্য সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে।’
বৈঠকে ছাত্র হত্যার বিচারের দাবিতে সরকারকে আন্তর্জাতিক আদালতের যাওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন সাকি। তিনি বলেন, ‘গুম খুনের বিচারের জন্য দ্রুত ট্রাইব্যুনাল করা দরকার।’
গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, আমদানি ও রফতানির দিকেও মনোযোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘রাষ্ট্র ব্যবস্থার গণতান্ত্রিক রূপান্তর করা দরকার। ফলে রাষ্ট্র ও সংবিধানের সংস্কার দরকার হবে। একটা গণতান্ত্রিক নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের দরকার হবে, গণতান্ত্রিক নির্বাচন লাগবে। ফলে আগামী নির্বাচনের সংবিধান সংস্কার হবে। আর সে নির্বাচনের ধরণ কী হবে, সেগুলো নিয়ে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করা দরকার। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও আলোচনার সূত্রপাত করতে হবে।’
আগামী নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়েছে কি-না, জানতে চাইলে সাংবাদিকদের সাকি জানান, ‘আলোচনা চলবে। পরিস্থিতি কীভাবে দ্রুত স্বাভাবিক করা যায় সে আলোচনাও হয়েছে।’ এসময় সাকি আরও জানান, ১৫ আগস্ট নিয়ে যে যার মতো বক্তব্য দিয়েছে।
এদিকে, মঙ্গলবার (১৩ আগস্ট) কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠক করার কথা রয়েছে।