সর্বস্তরের মানুষ এগিয়ে এসেছে, ত্রাণ বিতরণে দরকার পরিকল্পনা

ভারত থেকে উজানের পানি এসে নোয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লা ভাসিয়ে দেওয়ার দ্বিতীয় দিনে প্রাথমিক ধাক্কা কিছুটা সামলানো গেছে। বুধবার (২১ আগস্ট) পানি ঢোকার খবর ছড়িয়ে পড়লে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দলে দলে মানুষ রওনা দিতে থাকে মানুষকে বাঁচানোর তাগিদে। তখনও তারা বেশিরভাগেরই জানা নেই, পানির তীব্রতা ও আবহাওয়া পরিস্থিতি কতটা প্রতিকূল। প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাড়ির মাচায় কোনোরকমে টিকে থাকা মানুষ খবর দিতে পারছিল না তারা বেঁচে আছে। আর তাদের প্রায় প্রতিটা ঘরের যে সন্তান প্রবাসে আছেন, সেখান থেকে ভিডিওতে আবেদন জানাচ্ছেন, কাঁদছেন- আমার পরিবার বাঁচান। ঠিকানা, ফোন নম্বর, এলাকার বিবরণ দিয়ে ফেসবুকে জানান দিচ্ছিলেন আটকে পড়া স্বজনদের খবর। সে অনুযায়ী বেশ কয়েকজনকে উদ্ধারও করা হয়। দুদিন টানা বর্ষণ আর ঢলের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষকে উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া সম্ভব হয়েছে। উদ্ধারের প্রাথমিক উদ্যোগের পরে ত্রাণ বিতরণের চ্যালেঞ্জ এখন শুরু হবে।

যেকোনও দুর্যোগ পরিস্থিতিতে তরুণ সমাজের এগিয়ে আসার যে আগ্রহ, দলীয় ছাত্রদের উপস্থিতি না থাকায় এবার তা অন্যরূপে হাজির হয়েছে। যে যেখান থেকে পেরেছে বন্যাকবলিত মানুষকে সহযোগিতার জন্য ছুটে গেছে। কেউ কেউ বাড়িতে বসে অর্থ সংগ্রহের কাজটি করে গেছেন। মানুষের মনে হয়েছে আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কথা। দলীয়ভাবে নৌকার ব্যবস্থা করা, স্পিডবোটের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি, বড় দালানের মানুষেরা আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য তাদের কয়েক তলা ভবন ছেড়ে দিয়েছেন। একইসঙ্গে শুক্রবার (২৩ আগস্ট) প্রধান উপদেষ্টা ত্রাণ তহবিলে সাহায্য দিতে চাইলে করণীয় জানিয়েছেন।

বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিনিধির তথ্য বলছে, বৃহস্পতিবার রাতে বাঁধ ভেঙে কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলায় ১৫ ফুটের বেশি পানি ঢুকে পড়েছে। এখনও পানি প্রবল বেগে বুড়িচং উপজেলার দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে অবস্থান নিয়েছেন ঘরহারা মানুষজন। দেখা দিয়েছে খাবার ও চিকিৎসা সংকট।

অন্য অনেক প্রতিষ্ঠানের মতো বন্যার্তদের সহযোগিতায় একদিনের বেতনের সমপরিমাণ অর্থ প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে দিয়েছে সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর সকল পদবির সদস্যরা। তাছাড়া, সীমন্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরাও তাদের একদিনের বেতন বন্যার্তদের সহায়তায় দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ফেনী, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জে চলমান ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যার্থে মানবতার সেবায় এ অর্থ প্রদান করা হয়। যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আশিফ মাহমুদ এক মাসের বেতনসহ তার মন্ত্রণালয়ে নানা উদ্যোগ নিয়েছেন। এদিকে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি বলেছেন, ‘বন্যায় দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের কাছে ছুটে যাওয়াই এই মুহূর্তে বিএনপির প্রধান কাজ।’

ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাথমিক চ্যালেঞ্জ উদ্ধারকাজ পরিচালনা। পূর্বাঞ্চলের মানুষে বন্যার সঙ্গে পরিচিত না। ফলে কীভাবে নিজেদের রক্ষা করতে হয় সে বিষয়ে তাদের কোনও অভিজ্ঞতা ছিল না। তিস্তার পানি ছেড়ে দিলে রংপুরের মানুষ কীভাবে নিজেকে বাঁচাবে তা বছরের পর বছর ধরে সে শিখতে থাকে। ফলে নোয়াখালী ফেনীর মানুষকে উদ্ধার করাটাই বড় কাজ ছিল। আর এখন দীর্ঘদিন ত্রাণ লাগবে তাদের। সেটা বিতরণে একটা সমন্বিত পরিকল্পনা করা জরুরি। সবাই যার যার জায়গা থেকে সহায়তা করবে কিন্তু সেটা বিতরণের ব্যাপারে যদি সমন্বিত রূপ না থাকে তাহলে দেখা যাবে এক অঞ্চলের মানুষ বেশি সাহায্য পাবে, কোনও কোনও জায়গার মানুষ বঞ্চিত রয়ে যাবে।

অ্যাক্টিভিস্ট শিফাত বিনতে ওয়াহিদ ঢাকা থেকে গেছেন বুড়িচংয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। বন্ধুরা তার মাধ্যমে সহায়তা পাঠাচ্ছে। কী দেখছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, পানি এখনও বাড়ছে। স্রোত এত বেশি একজন আরেকজনের হাত না ধরলে না দাঁড়ায়ে ভাসায়ে নিয়ে যাবে। তারপরে গলা পর্যন্ত পানি না আসা পর্যাপ্ত মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে আগ্রহী না। বাড়ি ফেলে কোথাও যেতে চায় না। ফলে পানি বেশি বেড়ে গেলে উদ্ধারকাজ ব্যাহত হচ্ছে। ত্রাণের কী অবস্থা ওই এলাকায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, খাবার যাচ্ছে প্রচুর, কিন্তু পরিকল্পনার অভাব। কিন্তু খাবারের সঙ্গে এত সংখ্যক উৎসুক মানুষ যে একধরনের বিশৃঙ্খলার শঙ্কা আছে, এটা আয়োজকদেরই বন্ধ করতে হবে। তিনি বলেন, নিজে নিজে ওখানে যাওয়ার পরে একজনের মাধ্যমে কুমিল্লা বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ হলো। তাদের প্রয়োজন শুনে সেফটি জ্যাকেট, টর্চ, ওষুধ, শুকনা খাবার ব্যবস্থা করা হলো। রোটারি ক্লাবও ওদের সঙ্গে কাজ করছে। শিক্ষা বোর্ড সরকারি মডেল কলেজের প্রিন্সিপাল সমন্বয় করে দিচ্ছেন। আশ্রয়কেন্দ্রে যাদের নেওয়া হয়েছে তাদের জন্য খাবারের কী ব্যবস্থা সেটাও তারা দেখছেন। কোনও সরকারি উদ্যোগ দেখেছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিভিন্ন স্কুল-কলেজ থেকে আসা শিক্ষার্থী, রেডক্রিসেন্টের সদস্য দেখলেও আমি এখানে কোনও পুলিশ, ফায়ার সার্ভিসের কাউকে দেখিনি।

বন্যাকবলিত এলাকায় সহযোগিতার জন্য ত্রাণ সংগ্রহের কাজ করছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মী ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) প্রাঙ্গণে চলছে ত্রাণের বিশাল কর্মযজ্ঞ। সরেজমিন দেখা যায়, প্রবেশপথের পাশে ‘গণ-ত্রাণ সংগ্রহ’ বুথ বসানো হয়েছে। ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে সাধারণ মানুষ এসে নানা ধরনের ত্রাণ এখানে দিয়ে যাচ্ছেন। এগুলো পৌঁছানো হবে বন্যাকবলিত এলাকায়।

এত বড় দুর্যোগে ত্রাণ বিতরণে সমন্বিত পরিকল্পনা কী হতে পারে জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ নঈম গওহার ওয়ারা বলেন, এখন যে সময়, উদ্ধার এবং আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষকে আনাটাই জরুরি। কারোর ঢাকা থেকে যাওয়ার দরকার নাই— এই বার্তাটা আমাদের দিতে হবে। সবাই নিজ হাতে ত্রাণ দিতে চাইলে কীভাবে হবে। তিনি মনে করেন, এই মুহূর্তে সরকারের পদক্ষেপ নিতে হবে। উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কে কাজটা করবে সেটা নির্ধারিত থাকতে হবে। ইউনিয়ন কাঠামোর মধ্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি আছে। তরুণদের সম্পৃক্ত করে সেই কাঠামোকে কাজে লাগাতে হবে। না হলে এত বড় দুর্যোগ মোকাবিলা করা কঠিন হবে।