ভা
ফেনসিডিল নামক আপাত নিরীহ সিরাপটিই যে একদা বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের একটা বড় অংশকে মাদকের নেশায় আচ্ছন্ন করে রেখেছিল সেটা ঢাকায় সরকারি পরিসংখ্যানেও কখনও অস্বীকার করা হয়নি। ইদানীং বাংলাদেশের বড় শহরগুলোতে ইয়াবা বা কোকেনের মতো মাদক প্রায় অবাধে ঢুকে পড়লেও গ্রামে-গঞ্জে বা নিম্নবিত্তদের মধ্যে নেশার দ্রব্য হিসেবে ফেনসিডিল এখনও ভীষণ জনপ্রিয়। অনেকেই এই কাফ সিরাপকে ডাকেন ‘ডাইল’ নামে। যে নামটি দেশের নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের মধ্যেও চালু ছিল।
এমনকি আজও বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফ যে চোরাকারবারিদের আটক করে থাকে, তাদের কাছ থেকে জব্দ করা জিনিসপত্রের একটা বড় অংশ হলো এই ফেনসিডিল বা তার নানা জাল সংস্করণ!
ভারতে এতদিন ফেনসিডিল নামে জনপ্রিয় ওষুধটি তৈরি করে এসেছে অ্যাবট ইন্ডিয়া নামে প্রথম সারির একটি ফার্মাসিউটিক্যাল সংস্থা। কিন্তু বহু সময়েই অভিযোগ উঠেছে, এই ওষুধটিতে কোডিনের মাত্রা বিপজ্জনকভাবে বেশি এবং এটি নিষিদ্ধ করা উচিত।
এমনকি, বাংলাদেশে পাচার করার লক্ষ্যে বিশেষভাবে কোডিনের পরিমাণ বহুগুণ বাড়িয়ে ফেনসিডিলের কিছু ব্যাচ তৈরি করা হয় বলেও নানা সময়ে অভিযোগ উঠেছে। এই বিশেষ বোতলগুলোর পাঁচটাও যদি সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে পাচার করা যায়, তাহলে সেখানে সেগুলো ডাউলিউট করে অন্তত দশটা ফেনসিডিল বোতল বানিয়ে নেশার দ্রব্য হিসেবে বিক্রি করা হত বলে অভিযোগ।
ফেনসিডিল নিষিদ্ধ করার কথা ভারত সরকার বহুদিন ধরেই ভাবছে, কিন্তু অ্যাবট তাদের এই ‘ব্র্যান্ড’টি বাজারে টিকিয়ে রাখার জন্য পাল্টা লবিংও করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু অবশেষে আজ তাদের সব চেষ্টা পাকাপাকিভাবে বিফলে গেল, ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জারি করা বিজ্ঞপ্তিতে ফেনসিডিলসহ মোট ৩৪৪টি কোডিনযুক্ত ‘ককটেল ড্রাগ’কে নিষিদ্ধি করার কথা জানানো হয়েছে। এর মধ্যে আছে কোরেক্সের মতো আর একটি জনপ্রিয় কাফ সিরাপও, যা তৈরি করে থাকে ফাইজারের মতো বিখ্যাত বহুজাতিক ফার্মা কোম্পানি।
সরকারের এই সিদ্ধান্ত জানাজানি হওয়ার পরই ভারতের শেয়ার বাজারে ফাইজার ও অ্যাবটের দর পড়তে থাকে হু হু করে। পরে সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে ফাইজার দিল্লি হাইকোর্টের শরণাপন্ন হয়েছে, আদালত সরকারি নিষেধাজ্ঞার ওপর সাময়িক স্থগিতাদেশও জারি করেছেন। এর ফলে কোরক্সে বা ফেনসিডিল এখনই হয়তো ভারতে ওষুধের দোকানের তাকগুলো থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে না, কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন তারা নিশ্চিত যে এই ‘বিপজ্জনক’ ওষুধগুলো ভারত থেকে চিরনির্বাসনে পাঠানো যাবে।
কিন্তু কাগজে-কলমে ফেনসিডিল নিষিদ্ধ হওয়ার পরও যে প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে তা হল বাংলাদেশে কি এর পাচার বন্ধ করা যাবে?
ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফের এক আইজি পদমর্যাদার অফিসার বাংলা ট্রিবিউনকে সোমবার বলছিলেন, বাংলাদেশে ফেনসিডিল বলে যা পাচার হয়, তার প্রায় শতকরা সত্তর ভাগই কিন্তু আসল নয়, জাল। পশ্চিমবঙ্গে নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, উত্তর চব্বিশ পরগণা, মালদার মতো জেলাগুলোর বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে ঘরে ঘরে এই ফেনসিডিল বানানোর কারখানা ছেয়ে আছে। ফেনসিডিল বানানোটা সেখানে প্রায় কুটিরশিল্পের মর্যাদা পেয়ে গেছে। আর এগুলো পুরোটাই বানানো হচ্ছে বাংলাদেশের বাজারকে মাথায় রেখে। মাঝে মাঝে পুলিশি অভিযান হলে কিছুদিন তৎপরতা বন্ধ থাকে, তারপর আবার যে কে সেই।
ফলে দিল্লির হুকুমে ভারতে ফেনসিডিল আজ থেকে নিষিদ্ধ হলেও এই নকল কাফ সিরাপ বানানোর কারখানাগুলো নির্মূল করা যাবে কি না, সেই সংশয় কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। ভারতে বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষ থেকেও ফেনসিডিল নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানানো হয়েছে, কিন্তু সেই সঙ্গেই হাইকমিশনের এক কর্মকর্তা বলছেন, ‘সীমান্তে পাচারের ঘটনা কতটা কমে সেই হিসাব দেখলেই আসলে বোঝা যাবে, এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য কতটা উপকার বয়ে আনছে!’
/এমএনএইচ/