বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, বহুপাক্ষিকতার অধীনে বৈশ্বিক শাসন প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। বাড়ছে ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা। জলবায়ু পরিবর্তন বেড়েই চলেছে। ঋণের বোঝা অসহনীয়। বাড়ছে মানবিক সংকট। উন্নয়ন সহযোগিতায় রাজনৈতিক সদিচ্ছা দুর্বল হয়ে পড়ছে। বিশ্ব সম্মিলিত পদক্ষেপ একটি উদ্বেগজনক ঘাটতির মুখোমুখি।
বৃহস্পতিবার (২৭ মার্চ) চীনের হাইনানে বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া (বিএফএ) সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা এর আগে কখনও এতটা চাপের ছিল না। ২০০৭ সালে আমি বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়াতে ক্ষুদ্রঋণ বিষয়ে আলোচনা করি। আজ আমি ভিন্ন এক ভঙ্গিতে আপনাদের সামনে দাঁড়িয়েছি, এমন একটি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছি, যে বাংলাদেশ গত বছরের জুলাই-আগস্টে ঐতিহাসিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে গেছে। জুলুম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হতে দেখেছে বিশ্ববাসী।
তিনি বলেন, আমাদের তরুণ সমাজ ও নাগরিকরা বাংলাদেশের ভবিষ্যতকে নতুনভাবে নির্ধারণে ব্যতিক্রমী সংকল্প ও শক্তি দেখিয়েছে। জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে আমরা গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছি। নির্বাচনী ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, সিভিল প্রশাসন এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংস্কারের জন্য স্বাধীন কমিশন চালু করা হয়েছে। এই সংস্কারগুলো বাস্তবায়িত হলে তা আমাদের জাতির মৌলিক রূপান্তর নিয়ে আসবে।
নতুন বাংলাদেশ গড়তে গিয়ে আমরা বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছি, যা এশিয়ার অন্যান্য দেশও অভিন্ন করে নিয়েছে মন্তব্য করে ড. ইউনুস বলেন, বিশেষ করে বৈশ্বিক আর্থিক বাজারের অস্থিতিশীলতা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, কূটনৈতিক উত্তেজনা এবং বাণিজ্য বিঘ্ন অস্থিরতা তৈরি করে। ক্রমবর্ধমান সুদের হার এবং ঋণ পরিশোধের ব্যয় এশিয়ার ঋণ সংকটকে আরও গভীর করছে।
২০৩০ সালের এজেন্ডায় বৈশ্বিক প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও অগ্রগতি ধীর উল্লেখ করে তিনি বলেন, এসডিজি লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ২৪ শতাংশ পূরণ হয়েছে। উন্নয়নশীল এশিয়ার দেশগুলো বছরে ২ দশমিক ৫ থেকে ৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের এসডিজি অর্থায়ন ঘাটতির সম্মুখীন হয়। এসডিজি অর্থায়নের বাইরেও অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক বহুমুখীকরণে এশিয়ার বড় আকারের বিনিয়োগ প্রয়োজন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশ দুর্নীতি ও অবৈধ আর্থিক প্রবাহের শিকার হয়েছে। এই দুর্নীতির চর্চার কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলোর বার্ষিক আনুমানিক ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ হয়, যা তাদের প্রাপ্ত মোট ওডিএর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। সম্পদ পুনরুদ্ধার এবং প্রত্যাবর্তনের জন্য একটি বহুপাক্ষিক মধ্যস্থতা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এশিয়ার ঐক্যবদ্ধ হওয়া উচিত।
খাদ্য নিরাপত্তায় চাপ বাড়ছে জানিয়ে তিনি বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি পারিবারিক বাজেটের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর জন্য। জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ এই সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খল জোরদার করা জরুরি। বিশেষ করে মূল আমদানিকারক উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য জ্বালানি নিরাপত্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জ্বালানি সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ায় মূল্যস্ফীতি, অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও ঋণ সংকট দেখা দেয়। আমাদের অবশ্যই টেকসই শক্তির সমাধান খুঁজে বের করতে হবে এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।