‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারি করেছে সরকার। রবিবার (২৫ মে) রাতে অধ্যাদেশটি জারি করেন রাষ্ট্রপতি। এটি ২০২৫ সালে সরকারের ২৬ নম্বর অধ্যাদেশ। অধ্যাদেশের একটি ধারায় চারটি উপধারায় চারটি অপরাধের কথা বলা হয়েছে। যার জন্য চাকরিচ্যুতির বিধান রেখে যে চারটি উপধারা যুক্ত করা হয়েছে সেই চার উপধারায় আপত্তি জানিয়েছেন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এ কারণে তারা পুরো অধ্যাদেশটি বাতিল চেয়েছেন। কর্মচারীরা বলছেন, এটি কালো আইন। এটি তারা মানবেন না। সংশোধিত অধ্যাদেশে কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা সংকুচিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, চার ধরনের শৃঙ্খলাভঙ্গের অপরাধে বিভাগীয় মামলা ছাড়াই শুধু কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে সরকারি কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত করা যাবে। এ বিধানকে ‘নিবর্তনমূলক’ ও ‘গণতান্ত্রিক চেতনার পরিপন্থি’ বলছেন তারা। এটি বাতিল না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে। আন্দোলনকারী কর্মচারীরা এই অধ্যাদেশকে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক আখ্যায়িত করে তা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন।
জানা গেছে, অধ্যাদেশের ৩৭ক ধারায় বলা হয়েছে, সরকারি কর্মচারীদের আচরণ ও দণ্ড সংক্রান্ত বিশেষ বিধান: এই আইনে বা এই আইনের অধীন প্রণীত বিধিমালায় যাহা কিছুই থাকুক না কেন, যদি কোনও সরকারি কর্মচারী (আইনানুযায়ী সবাই কর্মচারী কোনও কর্মকর্তা শব্দ নেই) চারটি বিষয়কে অপরাধের আওতাভুক্ত করা হয়। সেগুলো হলো: (ক) সরকারি কর্মচারী যদি এমন কোনও কাজে লিপ্ত হন, যা অনানুগত্যের শামিল বা যা অন্য যে কোনও সরকারি কর্মচারীর মধ্যে অনানুগত্য সৃষ্টি করে বা শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করে বা কর্তব্য সম্পাদনে বাধার সৃষ্টি করে। (খ) অন্যান্য কর্মচারীর সঙ্গে সমবেতভাবে বা এককভাবে ছুটি ছাড়া বা কোনও যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া নিজ কর্ম থেকে অনুপস্থিত থাকেন বা বিরত থাকেন বা কর্তব্য সম্পাদনে ব্যর্থ হন, (গ) অন্য যে কোনও কর্মচারীকে তার কর্ম থেকে অনুপস্থিত থাকতে বা বিরত থাকতে বা তার কর্তব্য পালন না করার জন্য উসকানি দেন বা প্ররোচিত করেন এবং (ঘ) যে কোনও সরকারি কর্মচারীকে তার কর্মে উপস্থিত হতে বা কর্তব্য সম্পাদনে বাধাগ্রস্ত করেন, তাহলে তিনি অসদাচরণের দায়ে দণ্ডিত হবেন। এসব অপরাধের শাস্তি হিসেবে অধ্যাদেশে বলা হয়েছে— দোষী কর্মচারীকে নিম্নপদ বা নিম্ন বেতন গ্রেডে নামিয়ে দেওয়া, চাকরি থেকে অপসারণ বা চাকরি থেকে বরখাস্ত করার দণ্ড দেওয়া যাবে।
‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশে সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান যুক্ত করা হয়েছে। বিভাগীয় মামলা রুজু ছাড়াই শাস্তি দেওয়ার সুযোগ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, অভিযোগ গঠনের সাতদিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হবে। অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করা হলে তাকে কেন দণ্ড আরোপ করা হবে না, সে বিষয়ে আরও সাত কর্মদিবসের মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হবে। তার ভিত্তিতে দণ্ড আরোপ করা যাবে। এভাবে দণ্ড আরোপ করা হলে দোষী কর্মচারী ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে সেই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবেন। তবে রাষ্ট্রপতির দেওয়া আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে না। যদিও আদেশ পুনর্বিবেচনার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন বা আপিলের বিধান রাখা হয়েছে। আন্দোলনকারী কর্মচারীরা অধ্যাদেশকে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক আখ্যায়িত করে তা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন।
এ সংক্রান্ত অধ্যাদেশের খসড়াটি বাতিলের দাবিতে গত শনিবার (২৪ মে) থেকে দফতর ছেড়ে আন্দোলন শুরু করে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। রবিবার (২৫ মে) উত্তাল ছিল বাংলাদেশ সচিবালয়। হাজার হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী এ কর্মসূচিতে যোগ দেন। তারা সচিবালয়ের প্রবেশের প্রধান গেট আটকে দিয়ে ভেতরে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেন। কর্মচারীদের আন্দোলনে সচিবালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রম কার্যত থেমে যায়। অধিকাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারী দাফতরিক কাজে যোগদান করেননি। কর্মচারীদের সব সংগঠনের সভাপতি ও মহাসচিবকে সমাবেশে অংশ নিতে দেখা গেছে। একপর্যায়ে তারা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করেন। তাদের কাছে সমস্যাগুলো তুলে ধরেন। তারা এই অধ্যাদেশকে ‘নিবর্তনমূলক ও কালাকানুন’ আখ্যায়িত করে তা প্রত্যাহারের দাবি জানান। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ারও ঘোষণা দেন। কিন্তু সরকার তাদের দাবি আমলে না নিয়েই রবিবার সন্ধ্যায় ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ অধ্যাদেশের গেজেট প্রকাশ করেছে।
রবিবার সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের দফতরে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরাম। সংগঠনের সভাপতি ও সাবেক সচিব এবিএম আব্দুস সাত্তারের নেতৃত্বে কর্মসূচিতে সাবেক সচিব ও সংগঠনের কার্যকরী সভাপতি আব্দুল খালেক এবং সদস্য সচিব ও সাবেক সচিব মো. মেরাজ হোসেনসহ শতাধিক সাবেক সচিব ও অতিরিক্ত সচিব অংশ নিয়েছেন।
অপরদিকে সরকারের পক্ষ থেকে রবিবার (২৫ মে) সন্ধ্যায় সরকারি কর্মচারীদের দাবি-দাওয়া পর্যালোচনা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মতামত দিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবকে প্রধান করে দশ সদস্যের একটি স্থায়ী কমিটি গঠন করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। কমিটিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব (সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা-১), যুগ্মসচিব (বিধি-১), যুগ্মসচিব (মাঠ প্রশাসন, অভ্যন্তরীণ নিয়োগ ও নবনিয়োগ), যুগ্মসচিব (প্রশাসন অধিশাখা), মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন যুগ্মসচিব, অর্থ বিভাগের একজন যুগ্মসচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্মসচিব এবং লেজিসলেটিভ ও সংসদ-বিষয়ক বিভাগের একজন যুগ্মসচিবকে সদস্য হিসাবে রাখা হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব (সচিবালয় ও কল্যাণ অধিশাখা) কমিটিকে সাচিবিক সহায়তা দেবে বলেও প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে। কমিটি কত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে সে সম্পর্কে কোনও নির্দেশনা নাই।
কমিটির এখতিয়ারের বিষয়ে (টিওআর) আদেশে বলা হয়, সরকারি কর্মচারীদের যৌক্তিক দাবি-দাওয়া পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মতামত ও সুপারিশ দেবে। প্রতি মাসে এর সদস্যরা একবার সভায় মিলিত হবেন। কর্মচারীদের উপযুক্ত প্রতিনিধিদের সঙ্গে তারা মতবিনিময় করবেন। কমিটি প্রয়োজনীয় সংখ্যক সদস্য কোঅপ্ট করতে পারবে।
একই দাবিতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চলমান আন্দোলন সোমবারও (২৬ মে) অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সরকারি কর্মচারীদের দমন-নিপীড়নের জন্য যে নিবর্তনমূলক কালো আইন প্রণয়ন করেছে সে আইন বাতিল করাসহ কর্মচারীদের রেশন ও সচিবালয় ভাতা চালুর দাবিতে বাংলাদেশ সচিবালয়ের বাদামতলায় সমাবেশ করেছেন তারা।
বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের সভাপতি বাদিউল কবীর সোমবার বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছিলেন, বেলা ২টায় আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের সঙ্গে মিটিং আছে। সে মিটিংয়ে ফলপ্রসূ কোনও আলোচনা না হলে আগামীকাল মঙ্গলবার ২৭ মে থেকে কঠোর থেকে কঠোরতম আন্দোলনের ঘোষণা দেওয়া হবে। তবে সোমবার ২৬ মে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত (এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত) সেই মিটিং অনুষ্ঠিত হয়নি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নিজামউদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, আমরা আশাবাদী, রাতেও সেই মিটিং হতে পারে। যদি কোনও কারণে তা না হয় তাহলে আমাদের কর্মসূচি চতুর্থ দিনের মতো চলবে। তিনি জানান, আমাদের ঘরে ফিরে যাওয়ার সুযোগ নাই।
এ প্রসঙ্গে রবিবার বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরামের কর্মসূচিতে সংগঠনের সভাপতি সাবেক সচিব এবিএম আব্দুস সাত্তার গণমাধ্যমকে বলেন, সরকার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কথা বলতে দিতে চায় না। সার্ভিস সংক্রান্ত কোনও সমস্যা থাকলে কর্মচারীরা সংগঠনের মাধ্যমে তাদের অসুবিধার কথা বলেন। ক্যাডার ও নন-ক্যাডার সব ক্ষেত্রেই এটা প্রচলিত রীতি। কিন্তু নতুন করে সরকারি চাকরি (সংশোধিত) অধ্যাদেশ প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। সংশোধিত অধ্যাদেশে বিশেষ বিধান সংযোজন করে কর্মচারীদের টুঁটি চেপে ধরতে চায়। কোনোরকম তদন্ত ছাড়াই ২০ দিনে কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত করতে চায়। এটা সংবিধানবিরোধী কাজ।