২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা আজ

অর্থনীতিতে ১২ চ্যালেঞ্জ     

কয়েক বছর ধরে চলমান অর্থনৈতিক চাপ এবং গত বছরের আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের পর দেশের অর্থনীতি এক নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে। সেই চ্যালেঞ্জ নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ আজ সোমবার (২ জুন) বেলা ৩টায় বাংলাদেশ টেলিভিশনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম অর্থবছরের (২০২৫-২৬) বাজেট পেশ করবেন। সরকারের পক্ষ থেকে বারবারই বলা হয়েছে এবারের বাজেট হবে সংকোচনমূলক। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটের মোট আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। যা চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের তুলনায় ৭ হাজার কোটি টাকা কম। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী অর্থবছর সরকারকে অর্থনীতির ৭টি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। 

জানা গেছে, অন্তর্বর্তী সরকার যখন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য বাজেট প্রণয়নের প্রস্তুতি শেষ করেছে তখন অর্থ মন্ত্রণালয় ৭টি প্রধান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রমে ধীরগতির এই প্রেক্ষাপটে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা নতুন সরকারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান সরকারকে নতুন বছরের জন্য ঘোষিত বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অর্থনীতিতে ১২টি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। সেগুলো হলো- ১. মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, ২. রাজস্ব আদায়, ৩. দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ নিশ্চিতকরণ, ৪. বৈদেশিক সহায়তা প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণ, ৫. খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ৬. দক্ষ জনশক্তি তৈরি ও কর্মসংস্থান বাড়ানো, ৭. আর্থসামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ৮. শিল্পের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো, ৯. ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়ন এবং সরকারি কর্মচারী তথা প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরানো, ১১. পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার কৌশল এবং ১২. এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রস্তুতি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিনিয়োগ স্থবির, বেকারত্ব বৃদ্ধি, প্রবৃদ্ধি হ্রাস, বৈদেশিক বাণিজ্যে টানাপোড়েন, খেলাপি ঋণে ঊর্ধ্বগতিসহ নানামুখী চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশের অর্থনীতি। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা অর্থনীতিকে এই অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এটি মোকাবিলায় সমন্বিত নীতি গ্রহণ ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অপরিহার্য বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই বর্তমান সরকার তাদের প্রথম বাজেট পেশ করছে আজ।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট দেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি, কর্মসংস্থান, মানুষের জীবনমান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষায় বাড়তি নজর এবারের বাজেটের অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবে।

২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি ধরা হতে পারে ২ লাখ ৬৬ হাজার কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। । অতীতের রাজনৈতিক সরকারের মতোই ঘাটতির অর্ধেকেরও বেশি বিদেশি উৎস থেকে এবং বাকিটা ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। বাজেটে পরিচালন বা অনুন্নয়ন খাতে বরাদ্দ ধরা হতে পারে ৫ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা।

আগামী অর্থবছরে উন্নয়ন ব্যয় ধরা হতে পারে ২ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দ রাখা হতে পারে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৬ শতাংশ হতে পারে। এছাড়া মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার পরিকল্পনার কথা শোনাতে পারেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ।

সরকারের শীর্ষ মহল জানিয়েছে, আগামী অর্থবছরেই অনুষ্ঠিত হতে পারে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচন উপলক্ষে নতুন অর্থবছরের বাজেটে ২ হাজার ৮০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হতে পারে। তবে জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের জন্য আগামী অর্থবছরে ৫ হাজার ৯২২ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছিল নির্বাচন কমিশন।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সরকারের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা এবং বাজেট বাস্তবায়নে সুশৃঙ্খল প্রশাসন জরুরি। বিভিন্ন দাবিতে সচিবালয়সহ সারা দেশে সরকারি কর্মচারীরা আন্দোলনের মাঠে রয়েছেন। তাদের কাজে ফেরাতে হবে। যা বর্তমান সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতিতে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে উঠেছে। আগামী বাজেটে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আনা এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ধরে রাখা সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে একটি অনুকূল ব্যবসা ও বিনিয়োগ পরিবেশ তৈরি করা জরুরি। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর করে স্থিতিশীলতা আনা এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমানো এ ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। দেশের খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একটি মৌলিক প্রয়োজন। বিশ্ববাজারে অস্থিরতা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিবেচনায় এটি একটি ধারাবাহিক চ্যালেঞ্জ। আগামী বাজেটে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা থাকা দরকার। প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক তরুণ জনগোষ্ঠী তৈরি হচ্ছে, এই জনগোষ্ঠীকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরিত করা এবং তাদের জন্য পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা অর্থনীতির জন্য অপরিহার্য। এটি শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নয়, সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ বিধায় আগামী বাজেটে নেওয়া পলিসির ওপর নির্ভর করবে এর ভবিষ্যৎ। সেসব কারণে আগামী বাজেটে এটিও একটি চ্যালেঞ্জ। দেশের দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য আর্থসামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী শক্তিশালী করা প্রয়োজন। অর্থনৈতিক চাপ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সরকারের অন্যতম দায়িত্ব। সে কারণে আসন্ন বাজেটে এ বিষয়ে দিকনির্দেশনা থাকা জরুরি। সরকারের ব্যয় মেটাতে এবং উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে পর্যাপ্ত রাজস্ব আয় অপরিহার্য। কর কাঠামো সংস্কার, কর ফাঁকি রোধ এবং রাজস্ব আদায় প্রক্রিয়াকে আরও কার্যকর করা এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার মূল চাবিকাঠি। দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে একটি অনুকূল ব্যবসা ও বিনিয়োগ পরিবেশ তৈরি করা জরুরি। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর করে স্থিতিশীলতা আনা এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমানো এ ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের প্রক্রিয়া চলমান। এই উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় নীতি ও কৌশল গ্রহণ এবং সক্ষমতা বৃদ্ধি করা জরুরি। দেশের শিল্পের উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম চালিকাশক্তি। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও অবকাঠামো সুবিধা নিশ্চিত করে শিল্প খাতকে আরও শক্তিশালী করা এই চ্যালেঞ্জের অংশ।

জানা গেছে, গতানুগতিক প্রক্রিয়ার বাইরে এ বছর অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ টেলিভিশনে (রেকর্ড করা) আজ ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট উপস্থাপন করবেন।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আজ সকাল সাড়ে ৯টায় অনুষ্ঠিতব্য মন্ত্রিপরিষদের বিশেষ বৈঠকে অনুমোদন শেষে তাতে সই করবেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। এরপর অর্থ উপদেষ্টা বাজেট ডকুমেন্টস নিয়ে রামপুরার বিটিভি ভবনে যাবেন। সেখানেই রেকর্ড করা হবে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট। যা বিকাল ৩টায় সম্প্রচার করা হবে।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, বাজেট উপস্থাপনের পর দিন মঙ্গলবার (৩ জুন) অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলন করবেন। ওই সংবাদ সম্মেলনে বাজেট সম্পর্কিত সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের জবাব দেবেন তিনি। সংসদ কার্যকর না থাকায় এ বছর সরকার সাধারণ নাগরিকদের কাছ থেকে বাজেট সম্পর্কিত মতামত নেবে। দেশের যেকোনও নাগরিক বাজেট সম্পর্কিত যেকোনও মতামত অর্থ মন্ত্রণালয়ে পৌঁছাতে পারবেন। এসব মতামতকে একত্রিত করে যা গ্রহণ করা সম্ভব তা তিনি বাজেটে যুক্ত করে আগামী ২৩ জুন অনুষ্ঠিতব্য মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে উপস্থাপন করবেন চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য। মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে চূড়ান্ত অনুমোদনের পর তা রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হবে। যা ১ জুলাই ২০২৫ থেকে কার্যকর হবে।          

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আগামী বাজেট প্রসঙ্গে বলেছেন,  ‘দুঃখজনকভাবে এবারের বাজেটও গতানুগতিক হতে যাচ্ছে। খেলাপি ঋণ আদায়, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত ও করের আওতা বাড়ানোর মতো নতুন কিছু নেই। ফলে এবারের বাজেটে নতুন কোনও চমক থাকছে না। বর্তমানে যে প্রকল্পগুলো সরকারের কাছে রয়েছে তা অতিমূল্যায়িত। সেগুলোর ৪০ শতাংশ ব্যয়ই ভুয়া। অতীতের যে প্রকল্পগুলো থেকে রক্তক্ষরণ হতো সেগুলো এখনও অব্যাহত রয়েছে।’

বিগত সরকারের আমলের দুর্নীতি, ব্যাংক জালিয়াতি, করখেলাপি ও পাচার হওয়া অর্থ জব্দের পরামর্শ দেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তার মতে, এসব অর্থ জব্দ করে বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করা গেলে তা হতে পারে এবারের বাজেটের একটি অভিনব উৎস।

অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘নতুন অর্থবছরের বাজেট অত্যন্ত বাস্তবভিত্তিক হবে। বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ধার করে বড় বড় কোনও মেগা প্রকল্প করবো না। ব্যাংক থেকে ধার করে, নতুন টাকা ছাপিয়ে বাজেট বাস্তবায়ন করবো না।’