বিদ্যুতের তারে পোড়া জীবন!

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে যত পোড়া রোগী রয়েছেন, তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ইলেক্ট্রিক ক্যাবল বা বৈদ্যুতিক তারে শক খেয়ে আসা পুরুষ রোগী। এদের অনেকেরই হাত বা পা অপারেশন করে কেটে ফেলতে হচ্ছে। ফলে ক্ষত শুকিয়ে গেলেও মনের ক্ষত নিয়ে সারাজীবন বেঁচে থাকতে হচ্ছে এসব হতভাগ্য মানুষদের।
বার্ন ইউনিটের রেজিস্ট্রার খাতায় দেখা যায়, প্রতিদিনই বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে রোগীরা আসছেন ঢাকাসহ সারাদেশ থেকে।  
সরেজমিনে বার্ন ইউনিটে গিয়ে দেখা যায়, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে আসা ওসমান নামের রোগীটির ২৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। সঙ্গে থাকা বারো বছরের পুত্র নওশাদ মারা গেছে ঘটনায় পর পরই।যদিও পিতা ওসমানকে এখনও সে কথা জানানো হয়নি।
হাসপাতালে ওসমানের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল,গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ থানায় গত বুধবার দুপুর বারোটায় ঘটে এ ঘটনা।সেদিনই সন্ধ্যায় এখানে নিয়ে আসা হয় তাকে। অপারেশন শেষে জানা যায়,ভেতরের মাংসপেশিতে পচন ধরেছে।চিকিৎসকরা আশঙ্কা করছেন,তার বাম পাটি রাখা যাবে না,কেটে ফেলতে হবে।
বাগেরহাটের মোড়লগঞ্জ থানার দৈবঘাটি বাজার এলাকার ১৭ বছরের তুহিন।ডানহাতের কবজি কেটে ফেলা তুহিন জানালেন,২৭ ফেব্রুয়ারি রাস্তার ওপরে থাকা পুরানো তার বদলে নতুন তার লাগানোর কাজ করছিলাম।কাজ করার এক পর্যায়ে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। পরে হুঁশ হলে জানতে পারি, প্রায় ২০ সেকেন্ডের মতো তার ধরে ছিলাম আমি এবং পরে নিচে পড়ে যাই। প্রথমে খুলনা মেডিক্যালে নিয়ে যাওয়া হয়।সেখানে চিকিৎসা চলে পাঁচদিন।সেখানকার ডাক্তাররা বলেছেন,এই হাসপাতালে হাত বাঁচানো যাবে না।ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে গেলে  ডাক্তাররা চেষ্টা করে দেখতে পারেন।কিন্তু এখানে এসেও শেষ রক্ষা হয়নি।রগ ছিড়ে যাওয়ায় কবজি কাজ করতো না। সেজন্য কবজি কেটে ফেলতে হয়েছে।

তুহিনের সঙ্গে এসেছেন তার বাবা মা। মা নূরজাহান বলেন,আমার একটাই ছেলে।এই বয়সেই ওকে হাতটা হারাইতে হইলো।আমরা মইরা গেলে এই ছেলেকে কে দেখবে। ওর যে আর কোনও ভবিষ্যৎ রইলো না। এই বয়সেই ছেলেটা পঙ্গু হইয়া গেল, বলেই চোখের পানি ফেলতে থাকেন নূরজাহান বেগম।

বাবা অটোভ্যান চালক আবুল শেখ বলেন, যা হওয়ার তাতো হয়েই গেছে, কিন্তু ছেলেটা কি করে এখন জীবন কাটাবে সেই ভাবনাতে চোখে ঘুম নেই।    

ইলেক্ট্রিক বার্ন শরীরের যে জায়গাটায় হয় তার অনেক গভীরেও ইনজুরি থাকে। কারণ, ইলেক্ট্রিক বার্ন শরীরের টিস্যুগুলোকে নষ্ট করে দেয়।আমাদের শরীরের ছোট ছোট যেসব রক্তনালী রয়েছে সেগুলোকে জমাট বেঁধে দেয় ইলেক্ট্রিক বার্ন, বললেন বার্ন ইউনিটের অনানারি মেডিক্যাল অফিসার ডা. মুনিমা আলম । তিনি বলেন, প্রাথমিক অবস্থায় রোগী যখন চিকিৎসকের কাছে যান,তখন বাইরে যে ক্ষত দেখা যায় তার চেয়েও বেশি ক্ষত ভেতরে জমে থাকে। যে কারণে দিনকে দিন ইনজুরি বাড়তে থাকে।এক পর্যায়ে রক্তনালী বন্ধ হয়ে গেলে মাংসপেশীতে পঁচন ধরে যায়।তখন সেই অঙ্গটি হাত বা পা কেটে ফেলা ছাড়া কোনও উপায় থাকে না। 

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে,ইলেকট্রিক তারে জড়িয়ে আহত হওয়ার ঘটনায় সঙ্গে সঙ্গে বোঝা যায়না কতোভাগ আঘাত হয়েছে।প্রাথমিকভাবে তখন একটি গ্রেডিং করা হলেও ক্ষতস্থানের পরিমাণ বাড়তেই থাকে। শতকরা প্রায় পঞ্চাশ ভাগ ক্ষেত্রেই দুতিন দিন পরে বোঝা যায় যে, অঙ্গটা নষ্ট হয়ে গেছে এবং তা রক্ষা করার কোনও উপায় থাকে না তখন।

ইলেকট্রিক বার্নের আরেকটি প্রধান সমস্যা হলো,এতে মাংসপেশি নষ্ট হয়ে যায়।নষ্ট হওয়া মাংসপেশি থেকে বিষাক্ত মায়োগ্লোবিন বের হয়, আর এটি যদি কিডনিতে যায় তাহলে একটা সময় কিডনিও নষ্ট হয়ে যায়।

ডা. মুনিমা আলম বলেন,ইলেক্ট্রিক বার্নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ইলেক্ট্রিক বার্নে খুব কম শক নিয়েও বেশি মাত্রায় ক্ষতির সম্ভাবনা থেকে যায়। ইলেক্ট্রিক বার্নে হার্টের সমস্যা দেখা দেয়, এমনকি তাৎক্ষণিক মৃত্যুও হয় অনেকের।

ইলেক্ট্রিক বার্নে  সারাজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়। সাধারণত অন্য কোনও পোড়া রোগী চিকিৎসা শেষে অথবা ক্ষত স্থানে নতুন চামড়া লাগিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যান। কিন্তু ইলেক্ট্রিক তারে পোড়া রোগীদের সারা জীবন পঙ্গুত্ব নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়।বেশিরভাগ রোগীকেই অপারেশনের মাধ্যমে হাত পা কেটে ফেলে বাড়ি ফিরতে হয়,বললেন ডা.মুনিমা।

এপিএইচ/