সরেনি ট্যানারি, কাঁচা চামড়া ঠেকাচ্ছে পুলিশ

হাজারীবাগ ট্যানারির প্রবেশ পথ রায়ের বাজার বেড়িবাঁধে পুলিশএকাধিকবার সময় দিয়ে ও ট্যানারিগুলো সরাতে না পেরে শুক্রবার থেকে রাজধানীর হাজারীবাগে কাঁচা চামড়ার প্রবেশ ঠেকাতে বিভিন্ন পয়েন্টে বসানো হয়েছে পুলিশি পাহারা। আর এতে বিপাকে পড়েছেন সারাদেশের কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীরা। কারণ, এই পুলিশি পাহারা চালু থাকলে প্রতিদিন প্রায় ৫৫ হাজার পিস কাঁচা চামড়া আটকে থাকবে সারাদেশে ব্যবসায়ীদের গুদামে। লোকসান ঠেকাতে দেশের বাইরে কাঁচা চামড়া পাচার হওয়ার আশঙ্কার রয়েছে বলেও জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এদিকে, ট্যানারি মালিকরা এবারও ভেবেছিলেন সরকার এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ট্রাক, পিকআপে চামড়া আছে কি না, তা চেক করতে হাজারীবাগের প্রবেশ পথের বেড়িবাঁধ সড়কে বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। এছাড়া, কয়েকটি ট্যানারি কারখানার শ্রমিকরা জানিয়েছেন, শুক্রবার কারখানায় নতুন করে কোনও চামড়া আসেনি। হাজারীবাগের কিছু ট্যানারিতে পুরনো মজুদ থাকা চামড়া দিয়ে কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন শ্রমিকরা।
হাজারীবাগ থানা পুলিশ চামড়া প্রবেশের চারটি প্রবেশপথে শুক্রবার সকাল থেকে নজরদারি করছে বলে জানিয়েছেন হাজারীবাগ থানার ওসি মীর আলিমুজ্জামান। তিনি বলেন, কোনওভাবেই যেন চামড়া প্রবেশ করতে না পারে, সেদিকে নজর রাখা হচ্ছে।
বিভিন্ন জেলার কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রতিদিন প্রায় ৫৫ হাজার পিস গরুর চামড়া আসে। এরমধ্যে শুধু ঢাকার ৩ হাজার গরুর চামড়া হাজারীবাগে ট্যানারিগুলোয় সরবরাহ করা হয়। এছাড়া, মহিষ, ছাগল, বেড়ার চামড়াও ট্যানারিগুলোতে সরবরাহ করা হয়। পশু জবাই করার পর সংগ্রহ করা কাঁচা চামড়া লবণ দিয়ে প্রায় ২০ দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। ওই সব চামড়া হাজারীবাগের বিভিন্ন ট্যানারিতে সরবরাহ করা হয়। কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করে ট্যানারিগুলো পরবর্তী ব্যবহারের জন্য প্রক্রিয়াজাত করে সংরক্ষণ করেন। জেলা ভিত্তিক কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীদের সংগঠন থাকলেও দেশে কেন্দ্রীয় কোনও সংগঠন নেই। তবে, বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো সরকারের এ সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনা করে সমাধানের জন্য উদ্যোগ নিচ্ছে বলেও জানা গেছে।  

উল্লেখ্য, গত ২৯ ফেব্রুয়ারি শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু ট্যানারি স্থানান্তরে ৩১ মার্চ পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছিলেন মালিকদের। এপ্রিলের প্রথম দিন থেকে হাজারীবাগে কাঁচা চামড়া প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না বলেও ঘোষণা দেন মন্ত্রী। এর আগে গত ১০ জানুয়ারি মালিকদের গড়িমসিতে ক্ষুব্ধ শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেছেন, ‘যেসব ট্যানারি ৭২ ঘণ্টার মধ্যে হাজারীবাগ ছাড়বে না, সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া হবে।’ ওই সময়সীমা শেষে মন্ত্রী বলেছেন, ‘নোটিশ পাঠানো হবে। যেহেতু এটা আইনি প্রক্রিয়ার ব্যাপার, সেহেতু নোটিশের মাধ্যমেই তা করতে হবে।’ এরপরও ট্যানারি মালিকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সময় বাড়িয়ে ৩১ মার্চ পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়। এর আগেও কঠোর হুঁশিয়ারি দিলে সরকারের সিদ্ধান্তকে পাত্তা দেননি ট্যানারি মালিকারা। নানা অজুহাতে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারিগুলো সরাতে সময় নিয়েছেন ট্যানারি মালিকরা।

রাজশাহী কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী গ্রুপের সভাপতি আসাদুজ্জামান মাসুদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আজকে ঢাকায় চামড়া পাঠানো যায়নি। এভাবে যদি চলতে থাকে আমরা ক্ষতির মুখে পড়ব। শুধু রাজশাহী থেকে প্রায় ১০ লাখ টাকার চামড়া হাজারীবাগে যায়। সেখানে চামড়া সরবরাহ না করা গেলে চামড়াগুলোর কী হবে? গরমের দিনে ১৫ থেকে ২০ দিনের বেশি কাঁচা চামড়া সংরক্ষণ করা যায় না। সরকার কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীদের দিকে নজর না দিলে চামড়া দেশের বাইরে পাচার হয়ে যাবে।

নাটোর জেলা কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শরিফুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সপ্তাহে প্রায় ৫০ লাখ টাকার চামড়া নাটোর থেকে সরবরাহ করা হয় ট্যানারিগুলোতে। সরকার ট্যানারি মালিকদের প্লটসহ নানা সুযোগ সুবিধা দিলেও কারখানাগুলো সাভারে স্থানান্তরিত হয়নি। এখন যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, এর ফলে কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। অনেক ট্যানারিতে চামড়ার টাকা আটকে আছে। সেগুলো আদায় করতেও আমাদের এখন কষ্ট হবে। 

 হাজারীবাগ ট্যানারিতে মজুদ থাকা কাঁচা চামড়া

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব সাখাওয়াত উল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সরকারের  এ সিদ্ধান্তের ফলে দেশের চামড়া শিল্প ক্ষতির মুখে পড়বে। সরকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কোনও আলোচনা ছাড়াই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমরা ভেবেছিলাম, সরকার হয়ত এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে।

সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, আমরা বিদেশি ক্রেতাদের কাছ থেকে অর্ডার পেলে এলসি খুলে চামড়া সংগ্রহ করে উৎপাদন শুরু করি। এখন কাঁচা চামড়া না পেলে উৎপাদন সম্ভব হবে না। অর্ডার বাতিল হবে। আমরাও চাই সাভারে কারখানা স্থানান্তর করতে। এ জন্য সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন। আশা করছি, জুন-জুলাইয়ের মধ্যে ৫০টি কারখানা সাভারে কাজ শুরু করতে পারবে।

প্রসঙ্গত, ১৯৮৬ সালে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় পরিবেশ দূষণের দায়ে হাজারীবাগের ট্যানারি  কারখানাগুলোকে ‘লাল’ ক্যাটাগরিভুক্ত করে। সরকার সাভারে চামড়া শিল্পনগরী করে সেখানে ট্যানারিগুলো সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেয়। ২০০৩ সালের ১৬ আগস্ট একনেক সভায় চামড়া শিল্পনগরী প্রকল্পের অনুমোদন হয়। যদিও কাজ শেষ হতে এক যুগ পেরিয়ে যায়। ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত হাজারীবাগ থেকে সব ট্যানারিগুলোকে সাভারে সরে যেতে সময় দেওয়া হয়। কিন্তু সাভরে কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারের (সিইটিপি) নির্মাণকাজ শেষ না হওয়ায় একাধিকবার পেছায় সময়সীমা। হাজারীবাগ থেকে ১৫৫টি ট্যানারির সাভারে স্থানান্তরের জন্য প্লটও দেয় সরকার।

ছবি: সাজ্জাদ হোসেন

/এমএনএইচ/