নিজের বিশেষ সন্তানকে (অটিস্টিক) নিয়ে এভাবেই বললেন সাজিদা রহমান ড্যানি। সন্তানকে নিয়ে কাজ করতে গিয়ে গড়ে তুলেছেন অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের জন্য সংগঠন প্যারেন্টস ফোরার ফর ডিফরেন্টলি অ্যাবল। বর্তমানে তিনি এর প্রেসিডেন্ট।
শিশু একাডেমিতে বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত অটিস্টিক শিশুদের অনুষ্ঠান রিহার্সেলে বসে ড্যানি কথা বলেন এ প্রতিবেদকের সঙ্গে। জানালেন, নিজের ছেলেকে নিয়ে পরিবার, সমাজের সঙ্গে যুদ্ধের কথা। জানালেন, যুদ্ধ শেষে তিনি একজন প্রাউড মাদার, নিজের ছেলেকে নিয়ে গর্ব হয় তার।
জানালেন, ২১ বছর বয়সী ছেলে সিয়ামুল করিম এখন তিনটি ভাষায় কথা বলতে পারে। এ লেভেল করছে ব্রিটিশ স্ট্যার্ন্ডাড স্কুল থেকে। রেগুলার স্কুলে পড়েছে,অবশ্যই রেগুলার স্কুলের কিছু ইস্যুস থাকে। ব্রিটিশ কাউন্সিলের অধীনে পরীক্ষা দেবে আর ভোকেশন্যাল ট্রেনিং সেন্টারে অফিস অ্যাসিসট্যান্ট হিসেবে কাজ করছে। ওর ইচ্ছে, বড় হয়ে সে নিজের মতো করে স্বাধীনভাবে (ইন্ডিপেনডেন্ট)জীবন কাটাবে। সে জন্য নিজের কাজগুলো কিভাবে সে করবে সেই প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিভাবে বাইরে যেতে হয়, টাকা ম্যানেজ করতে হয়, লোকাল যানবাহনে কিভাবে উঠতে হয়, ঘরের কাজ কিভাবে করতে হয়, নিজের নিরাপত্তা কিভাবে নিজেই করবে-এগুলো শিখছে এখন। মোটামুটি শিখে ফেলেছে। বললেন, সিয়াম উঠে আসতে পারবে-সে আমি বিশ্বাস করি।
সামনে থাকা পুত্র সিয়ামকে দেখতে দেখতে বলেন, আমি যখন কনসিভ করি তখন সবচেয়ে বড় ভয় ছিল মানুষ করতে পারবো কিনা আমার সন্তানকে। জন্ম তো দেওয়াই যায়, কিন্তু মানুষ করাটা সবচেয়ে কঠিন বিষয় মনে হয়। বিশ্বে যতো কঠিন কাজ রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে কঠিন কাজ হচ্ছে, সন্তানকে মানুষ করা,আমার মনে হয় সেই কাজটি আমি যথেষ্ট মনোযোগ দিয়ে, ডেডিকেশন দিয়ে করার চেষ্টা করেছি। একজন বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন মানুষ হয়েও অসম্ভব রকমের প্রতিন্ধকতার মাঝে থেকেও সে ইন্ডিপেনডেন্ট মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখছে, মানবিক গুণাবলী, নীতিবোধ তার মধ্যে আমি পুরোপুরি দিতে পেরেছি-সবটুকু হয়তো আসেনি, কিন্তু যতোটুকু এসেছে, আমার মনে হয় সিয়াম সেটুকু নিতে পেরেছে-আমার স্বার্থকতা ওই জায়গাতেই। সিয়াম উঠে আসতে পেরেছে- আমি বলি হ্যাঁ, আই অ্যাম রিয়েলি অ্যা প্রাউড মাদার, আই অ্যাম অ্যা ব্লেসড মাদার।
বলেন, সিয়ামকে ধন্যবাদ জানাই, কারণ মাতৃত্ব জিনিসটা সিয়াম আমাকে প্রতিটি পদে ধরিয়েছে, শিখিয়েছে। আমরা মা-ছেলে এক সঙ্গে বড় হয়েছি, শিখেছি, একসঙ্গে অনেক কিছু বুঝতে শিখেছি।
চোখের কোণে আসা চিকচিকে জল নিয়েই বললেন, সিয়ামের অনেকগুলো বিষয় নিয়ে প্রাউড ফিল করি এবং আমি সবসময় চেষ্টা করেছি। আমি স্রষ্টাকে ধন্যবাদ দেই, তিনি আমাকে জীবনের এই জায়গাতে নিয়ে এসেছেন, দেখিয়েছেন। কারণ, জীবনের এতো যে নানা ধরন, বাঁক আছে, একটা মানুষের মধ্যে শুধু অদৃশ্য এতো কিছু থাকতে পারে সে সম্পর্কে আমার কোনও ধারণাই ছিল না।
সিয়াম অটিজমে আক্রান্ত এটা চিকিৎসকরা বলছিলেন, কিন্তু কোন ধরনের অটিজম সেটি বুঝতে পারছিলাম না। সাড়ে ছয় বছর বয়সে আমি ব্যাংককে গেলাম ওকে নিয়ে, সেখানেই প্রথম ধারণা পেলাম সিয়ামের কি ধরনের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। জানলাম,অটিজমের সঙ্গে সর্ম্পকিত সকল ধরনের সমস্যা আমার ছেলের রয়েছে। ওই সময়েই আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে আমি কি করবো। যদি পরিবারের দিকে যাই তাহলে সিয়ামকে তুলে আনতে পারবো না। কারণ ঘরের সঙ্গে যুদ্ধ করে বাচ্চাকে নিয়ে যুদ্ধ করা যায় না-দু’টো যুদ্ধ এক সঙ্গে করা যায় না। তখনি আমার মূল যুদ্ধটা শুরু হলো জীবনে। তখনি আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমার ছেলেকে নিয়ে আমি জীবন শুরু করবো, কারণ ওর ইমপ্রুভমেন্টটাই আমার কাছে মুখ্য, আর কিছু নয়।
জন্ম দেওয়াটা যদি বাবা হিসেবে গণ্য করা হয় তাহলে সেই হিসেবে ওর একজন বাবা রয়েছে, কিন্তু অন্য ক্ষেত্রগুলোতে ওকে বড় করে আনা বা অন্যও কোনও কাজে আমার মনে হয় না,ওর বাবার কোনও জায়গা ছিল সেখানে। এভাবেই সমাজ আমাদের যাওয়ার জায়গাটা করে দিয়েছে, উই ডোন্ট হ্যাভ অ্যানি আদার চয়েজেজ।
সিয়ামকে নিয়ে স্কুলের যুদ্ধটাও ছিল অনেক বেশি জানিয়ে তিনি আরও বলেন, আমি ঢাকার অন্তত ত্রিশটি স্কুলে গিয়েছি তাকে ভর্তি করাতে, কেউ নেয়নি, তারা বলতো, এটা তো অটিস্টিকদের জন্য স্কুল না, এখানে কেন এনেছেন, তারা এমন কথাও বলতো চোখের পানি ধরে রাখতে পারতাম না। আজকের অবস্থানে আসতে আমাকে অনেক চড়াই-উৎরাই পার হতে হয়েছে।
নিজের ওপর সাইকোলজিক্যাল একটা প্রেসার, বাচ্চাকে নিয়ে যুদ্ধ, সামাজিক যে কটূ কথার ধার,বাস্তবতার বিষয় ধারণ করা –সবকিছু নিতে পারিনি, ওই শক্তিটা তখন আমার ছিল না, যে শক্তি আমি ধীরে ধীরে অর্জন করেছি, আমাকে শিখতে হয়েছে কিভাবে পথ চলতে হবে, এটা অনেক বছর চলেছে। এর মধ্যে যতো কষ্টই হোক, সিয়ামের সার্পোটে কোনও কমতি আমি রাখিনি, হতে দেইনি। এখন যে সিয়ামকে দেখছে সবাই-সেটা আমার একার যুদ্ধের ফলাফল। এখানেই আমি জয়ী-পাশে থাকা ছেলের দিকে বিজয়ীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন যুদ্ধ জয়ী একজন মা।
/এমএসএম/