বাংলা বছরের প্রথম দিবস উদযাপনের সবচেয়ে বড় পরিচয় অসাম্প্রদায়িকতা। বাংলা নববর্ষ শুধুই প্রকৃতি ও তার সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠা মানুষের জীবনাচরণকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া। এমন লোকায়ত এবং জনমানুষসম্পৃক্ত ক্যালেন্ডার খুব কম আছে বলেই বাংলা নতুন বছর বাঙালিকে শেকড়ের সন্ধান দেয়। পুরাতনকে বিদায় দিয়ে নতুনকে আলিঙ্গনের অনন্য উদাহরণ হিসেবে দিনটি সামনে আসে, আনন্দে মাতিয়ে আগামীর দিনগুলোর লড়াইয়ে সাহস যোগায়।
সেই পথ পাড়ি দিয়ে আরেকটি নতুন বছরে পা রাখল বাংলাদেশ। নতুন সূর্যোদয়ের মধ্য নিয়ে শুরু হলো বছরের প্রথম দিবস। এবারই প্রথম দিবসটি জাতীয় উৎসব ঘোষিত হওয়ায় গোষ্ঠী উদ্যোগের পাশাপাশি এবার সরকারিভাবে নানা কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বাণী প্রদান, বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় ক্রোড়পত্র প্রকাশ প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি আছে সব কারাগার, হাসপাতাল ও এতিমখানায় উন্নতমানের ঐতিহ্যবাহী খাবারের ব্যবস্থা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি, শিশু একাডেমি ও লোকশিল্প জাদুঘরে বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক কার্যক্রম।
সরকারি কর্মকর্তারাদের বোনাস দিতে দেখে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বেসরকারি বেশকিছু প্রতিষ্ঠানেও কর্মকর্তাদের বৈশাখী বোনাস দেওয়া হয়েছে। আগামীতে বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্যও বৈশাখী বোনাস বাধ্যতামূলক করার কথাও ভাবছে সরকার। এর ফলে অসাম্প্রদায়িক বৈশাখী উৎসবের ‘নববর্ষ ভাতা’ রাষ্ট্রীয়ভাবে সর্বজনীন রূপ পেতে যাচ্ছে।
পহেলা বৈশাখ বাংলা সনের প্রথম দিন। দিনটি বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নববর্ষ হিসেবে বিশেষ উৎসব ও উৎসাহের সঙ্গে পালিত হয়। ত্রিপুরায় বসবাসরত বাঙালিরাও এই উৎসবে অংশ নিয়ে থাকে। উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে, গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে ১৪ এপ্রিল অথবা ১৫ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ পালিত হয়। আধুনিক বা প্রাচীন যে কোনও পঞ্জিকাতেই এই বিষয়ে মিল রয়েছে। বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৪ এপ্রিল এই উৎসব পালিত হয়। বাংলা একাডেমি নির্ধারিত আধুনিক পঞ্জিকা অনুসারে এই দিন নির্দিষ্ট করা হয়েছে।
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান এ বিষয়ে বলেন,‘সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখতে নানাসময় উদ্যোগের দরকার হয়। বাংলা নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে জাতীয় রূপ দেওয়া এবং উৎসব ভাতা দিয়ে উৎসাহিত করার মধ্য দিয়ে এর সার্বজনীনতা বজায় থাকবে বলে আমার বিশ্বাস।’
কেন ভোরে বাংলা বছর শুরু
রাত ১২টায় নয়, বাংলা বছর শুরু হয় সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে। ইংরেজি সালের তারিখ গণনা রাত ১২টার পর শুরু হয়। এমন গণনার পেছনে কারণ হলো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি। একটি চক্র শুরু হয়ে শেষ হলেই দিন শেষ হয় অর্থাৎ ঘড়ির কাঁটাই এখানে মূল ভিত্তি। তাই প্রতিবছর ইংরেজি নতুন বছর শুরু হয় ঘড়ির কাঁটা ঠিক রাত ১২টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে।
হিজরি সালের তারিখ গণনা করা হয় সন্ধ্যার পর থেকে। কারণ হিজরীর দিন হিসেব করা হয় চাঁদ দেখার ওপর ভিত্তি করে। তাই চাঁদ উঠলেই সন্ধ্যা থেকে হিজরি নতুন দিন শুরু। আর বাংলা নববর্ষে নতুন বছরের দিন শুরু হয় সকালে সূর্যদয়ের পর থেকে। এর অন্যতম কারণ হল কৃষিকাজ। কারণ সম্রাট আকবর বাংলা সালকে ফসল তোলার ওপর ভিত্তি করে খুব সুন্দর করে বিন্যাস করেছিলেন। তখন সূর্য ওঠার পর কৃষিকাজ শুরু হত এবং তার ভিত্তিতেই দিন গোণাও শুরু হত। ইংরেজি নতুন বছরের মত রাতে কোনও উৎসবের আয়োজন করা হতো না। ফলে সূর্যদয়ের পর সকাল থেকেই শুরু হতো নববর্ষের আচার-অনুষ্ঠান।
প্রধান দুই কর্মসূচি: রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ ও মঙ্গল শোভাযাত্রা
ঢাকা শহরে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দু সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের নতুন বছরের সূর্যকে আহ্বান। পহেলা বৈশাখ সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ছায়ানটের শিল্পীরা সম্মিলিত কণ্ঠে গান গেয়ে নতুন বছরকে আহ্বান জানালেন। ১৯৬০ এর দশকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসের প্রতিবাদে ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানটের এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা। এরপরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে শুরু হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। এই শোভাযাত্রাটি বের হয়ে শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে পুনরায় চারুকলা ইনস্টিটিউটে এসে শেষ হয়। শোভাযাত্রায় সব শ্রেণী-পেশার বিভিন্ন বয়সের মানুষ অংশগ্রহণ করে। মাসব্যাপী কাজ করে শিক্ষার্থীরা শোভাযাত্রার জন্য তৈরি করে রং-বেরঙের মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিলিপি। যা কিছু অমঙ্গলজনক তা বিসর্জন দেওয়া হয় শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে।
এমএসএম/এজে/