বাঘের থাবায় ২২ বছর!

হাসমত আলীহাসমত আলী মুখের বাম পাশে সবসময় ছোট ‍রুমাল কিংবা গামছা বেঁধে রাখেন। শিশুরা তো বটেই, বড়রাও তার চেহারা দেখলে ভয়ে আঁতকে ওঠেন। ১৯৯৫ সালের এক রাতে বাঘের হামলা থেকে কোনও রকমে জীবন নিয়ে ফিরে এসেছিলেন হাসমত আলী। তবে বাঘের থাবায় তার মুখের বাম পাশ একেবারে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায়, নষ্ট হয়ে যায় বাম চোখটাও। তাই অন্যদের অস্বস্তিতে না ফেলতে তাকে সবসময় মুখের বাম পাশে রুমাল বা গামছা বেঁধে রাখতে হয়।

গত বুধবার হাসমত আলী চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয়েছেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। আগামী রবিবার একটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হবে তার জন্য। সেই বোর্ডের নির্দেশনা অনুযায়ী চলবে চিকিৎসা।

হাসমত আলীর বয়স ৩৮ বছর, লেখাপড়া তেমন করেননি। বাবা নেই, বৃদ্ধা মা, স্ত্রী, ছেলেমেয়েদের নিয়ে সংসার। সাতক্ষীরার শ্যামনগরের বাসিন্দা হাসমত সুন্দরবন সংলগ্ন নদীতে মাছ ধরে বিক্রি করে সংসার চালান। কিন্তু ১৯৯৫ সালের এক দুঃস্বপ্নের রাত তার জীবনকে ঢেকে দিয়েছে অন্ধকারে।

সেদিনের দুঃসহ অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে আজও শিউরে ওঠেন হাসমত। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সেবারও গিয়েছিলাম মাছ মারতে, সঙ্গে ছিল দুই জন। সমুদ্রে চার/পাঁচ দিন থাকার পরে এক রাতে একটি খালে নৌকা ভিড়াই ঘুমানোর জন্য। সেদিনই ভোররাতের দিকে বাঘ এসে থাবা মেরে নিয়ে যেতে থাকে আমাকে,  অনেক চেষ্টা করেও নিজেকে ছাড়াতে পারছিলাম না কিছুতেই। বাঘটা আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু নৌকা থেকে নামার সময় বাঘটা পানিতে পড়ে যায় আর আমি প্রাণে বেঁচে যাই।’

হাসমত আরও বলেন, ‘আমার সঙ্গীরা আমার ক্ষতবিক্ষত দেহ নিয়ে নৌকায় করে সঙ্গে-সঙ্গে রওনা দিয়েছিলো। একদিন পর সুন্দরবনের পাশেই ঘাটখালিতে পৌঁছাই। সেখানে হাসপাতালে নিলেও তারা আমাকে ভর্তি করেনি। এরপর সাতক্ষীরা হাসপাতালের ডাক্তাররাও আমাকে ফিরিয়ে দেন। পরে খুলনা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয় আমাকে। সেখানে এক থেকে দেড় বছরে চার/পাঁচবার অপারেশন হয়।কিন্তু সেই হাসপাতালের ডাক্তাররা বেশি কিছু করতে পারেননি। তারা বলেছেন, আর কিছু করা সম্ভব নয় তাদের পক্ষে।

বাঘের থাবা থেকে বেঁচে গেলেও জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে হাসমতের। তিনি বলেন ‘প্রায় ২২ বছর ধরে বাঘের থাবার আঘাত নিয়ে বেঁচে আছি। প্রাণে বেঁচে গেলেও জীবনটা দুঃসহ হয়ে উঠেছে। এতো বছর ধরে এভাবে জীবনযাপন করার কী সমস্যা, সেটা বুঝি। কিন্তু কিছু করার নেই। আমার এত টাকা নেই যে কোনও বড়, বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করাবো। অবশেষে বিদেশ থেকে লোক এসে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে।’ হাসমতের মামা আবুল হোসেন জানালেন, একটি বিদেশি টেলিভিশন চ্যানেলের কয়েকজন সাংবাদিক হাসমতকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন।

নিজের দুঃখের কথা তুলে ধরে হাসমত বলেন, ‘১৯৯৯ সালে বিয়ে করি, কারণ পাশে থাকার জন্য আমার একজনকে দরকার ছিল। আমাদের তিন ছেলে মেয়ে। ঘরের  মানুষরা ছাড়া কেউ আমার চেহারা কোনওদিন দেখেনি। কোনও স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে এই মুখ দেখা সম্ভব নয়।’

হাসমতের সুস্থ হয়ে ওঠার ব্যাপারে আশাবাদী ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের প্রধান সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ছয় মাস আগে লন্ডন থেকে ডিসকভারি চ্যানেলের একজন সাংবাদিক আমাকে হাসমতের কথা জানায়। আমি মনে করি, আমাদের ওপর মানুষের আস্থা ফিরে আসছে, যেটা নিশ্চিত হয়েছে বৃক্ষমানব আবুল বাজানদারের মাধ্যমে।’

হাসমতের চিকিৎসার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আগামী রবিবার একটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হবে, যেখানে বার্ন ইউনিটের অধ্যাপকরাসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা থাকবেন। বোর্ডের নির্দেশনা অনুযায়ী হাসনাতের চিকিৎসা চলবে।’

ডা. সামন্ত লাল সেন আরও বলেন, ‘আমরা হাসমতকে স্বাভাবিক মানুষের মুখের আদল দেওয়ার চেষ্টা করবো। সেটা একটা অপারেশনের মাধ্যমে সম্ভব নয়। আমাদের ধারণা, পাঁচ থেকে সাতটি অপারেশন লাগবে। মাইক্রো সার্জারি করে তার মুখের খোলা অংশ ভরাট করতে হবে। তারপর কৃত্রিম চোখ লাগাবার ব্যবস্থা করা হবে।  আবুল বাজানদারের মতো বাঘের থাবা থেকে বেঁচে আসা হাসনাতের চিকিৎসাকেও আমরা চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়েছি।’ হাসনাতের চিকিৎসার পুরো খরচ সরকার বহন করবে বলেও জানান ডা. সেন।

এএআর/