প্রতিটি পাবলিক ও নিয়োগ পরীক্ষা শুরুর আগে বা পরীক্ষা চলাকালীন যে বিষয়টি সবচেয়ে আলোচিত হয় তা হচ্ছে প্রশ্নফাঁসের গুঞ্জন। তবে সব সময় এগুলো গুঞ্জনই থাকে না, এসব অভিযোগের অনেক সময় সত্যতাও মিলেছে। পুলিশ ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের তদন্তে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে ছাত্র, শিক্ষক ও অভিভাবকদের সম্পৃক্ততাও পাওয়া গেছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের এই সমস্যা সমাধানে পুলিশের পরামর্শ, প্রশ্নপত্র বণ্টনে আরও নজরদারি বাড়াতে হবে এবং দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা সচেতন না হলে এই সংকট কাটানো সম্ভব নয়।
সোমবার রাজধানীর তেজগাঁও এলাকার সাতরাস্তা থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস ও বিক্রির অভিযোগে একজন অধ্যক্ষ, তিনজন শিক্ষক, এক অফিস সহকারী ও চার ছাত্রসহ মোট ৯ জনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি)পুলিশ। গ্রেফতারকৃতরা হলেন, আশুলিয়ার গাজীরচট এএম উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ মো. মোজাফফর হোসেন, টঙ্গীর কোনিয়া কোচিং সেন্টারের শিক্ষক মো. হামিদুর রহমান ওরফে তুহিন, সৃষ্টি সেন্ট্রাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের গণিত শিক্ষক মো. জাহাঙ্গীর আলম, এএম উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ শিক্ষক মো. আতিকুল ইসলাম, অফিস সহকারী মো. আব্দুল মজিদ এবং ছাত্র মো. আরিফ হোসেন আকাশ ওরফে আদু ভাই, মো. সাইদুর রহমান, মো. রাকিব হোসেন ও তানভীর হোসেন।
এ বিষয়ে ডিবি পুলিশের যুগ্ম কমিশনার আব্দুল বাতেন বলেন, ‘আমরা প্রশ্নপত্র ফাঁসের সোর্সকে চিহ্নিত করার জন্য তিনটি জায়গায় নজরদারি করেছি। প্রথমত, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন কমিটি বা ম্যানেজমেন্ট কমিটি। দ্বিতীয়ত যেখান থেকে প্রশ্ন ছাপানো হয়। তৃতীয়ত, প্রশ্নপত্র জেলা প্রশাসক ও বিভিন্ন সময় যেসব কেন্দ্র থেকে বণ্টন হয়। এরমধ্যে আমরা তৃতীয় জায়গা থেকে ফাঁস চক্রের দুইটি চক্রকে গ্রেফতার করেছি। তারা প্রাথমিকভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁসের কথা স্বীকার করেছেন।’
তিনি বলেন, ‘গ্রেফতারকৃত মো. মোজাফফর হোসেন আশুলিয়ার গাজীরচট এএম উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ। ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষার কেন্দ্র রয়েছে। পরীক্ষার একঘণ্টা আগে যখন বিভিন্ন কক্ষে প্রশ্ন বণ্টনের প্রক্রিয়া শুরু হয়, তখন তারা সেগুলোর ছবি দ্রুত মোবাইলে তোলেন। তারা মূলত এমসিকিউ বা শর্ট প্রশ্নগুলোর ছবি তুলে, সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের দিয়ে তার সমাধান করিয়ে থাকেন। এরপর সেই উত্তর তাদের একটি ক্লোজ ফেসবুক গ্রুপে ছেড়ে দেন। ওই গ্রুপে প্রায় দুই হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে। শিক্ষার্থীরা উত্তর পেয়ে তারপর পরীক্ষার হলে যায়। এজন্য প্রত্যেক শিক্ষার্থী ৫শ’ থেকে ৫ হাজার টাকা বিকাশে পাঠিয়ে থাকে। এই টাকা আবার এই চক্রটি ভাগ করে নিয়ে থাকেন। একইভাবে সৃষ্টি সেন্ট্রাল স্কুল ও কলেজের গণিত শিক্ষক মো. জাহাঙ্গীর আলমও তার স্কুল থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে আসছিলেন।’
তিনি বলেন, ‘প্রিন্সিপাল মো. মোজাফফর হোসেনের নেতৃত্বে অন্যান্য আসামি দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন নামে ফেসবুক গ্রুপে, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপ এর মাধ্যমে বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার পূর্বে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অবৈধ অর্থ আত্মসাৎ করেন।’
এর আগে, গত ৮ মার্চ ঢাকা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ময়মনসিংহ, জামালপুর ও কুষ্টিয়া জেলায় অভিযান চালিয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত আট সদস্যকে গ্রেফতার করে ডিবি। তারা হলেন— কমলাপুর শের-ই-বাংলা রেলওয়ে উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক রফিকুল ইসলাম, তার সহযোগী জহিরুল ইসলাম ওরফে শুভ, লিটন ওরফে আকাশ, রুমন ওরফে মাহির, রাজিব আলী, আরিফুল ইসলাম ওরফে আরিফ, তারিকুজ্জামান হিমেল ওরফে আবির ও অন্তর। এর দুইদিন পর রেলওয়ে উচ্চ বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ আব্দুল আলিমকেও গ্রেফতার করে পুলিশ।
এই ঘটনায় আইসিটি অ্যাক্ট ও পাবলিকেশন এ্যাক্ট-এ মতিঝিল থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। গ্রেফতারকৃত শিক্ষক ও অন্যদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। ইতোমধ্যে রফিকুল ইসলাম, তার কোচিং সেন্টারের খণ্ডকালীন শিক্ষক সহযোগী জহিরুল ইসলাম ওরফে শুভ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।
ডিবি দক্ষিণের উপ-কমিশনার মো. শহীদুল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কমলাপুরের ওই স্কুলের এক শিক্ষকসহ দু’জন জবানবন্দি দিয়েছে। তারা নিজেদের দোষ স্বীকার করেছে। তাদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য পেয়েছি আমরা, সেগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে।’
ডিবি দক্ষিণের তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, স্কুলের ভালো ফলাফলের মাধ্যমে সুনাম অর্জন করতে শিক্ষকরাই প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িয়েছেন। তাদের কারণেই পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ছাত্রছাত্রীদের হাতে আগেই চলে যায়। তাদের কাছে অভিযোগ রয়েছে, রাজধানীর আরও অন্তত ৬টি স্কুল প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, ফেসবুকের ওই গ্রুপটিতে এবারের এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা রয়েছে। পরীক্ষার্থীরা যেহেতু অনেক টাকা দিয়ে প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করে, তাই এতে অভিভাবকরাও শিক্ষার্থীদের প্রশ্রায় দিয়ে থাকে। সবারই সচেতন হতে হবে।
মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ কর্মকর্তা আব্দুল বাতেন উদাহরণ দিতে গিয়ে বলেন, ‘চালের ছিদ্র বন্ধ না করে মেঝে মুছলে কখনও মেঝে শুকানো যাবে না। যেখান থেকে প্রশ্ন বন্টন হয়, সেই জায়গায় যারা রয়েছেন, তাদের আরও সচেতন ও দায়িত্বশীল হতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘সামনে এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হবে। আমাদের নজদারি আরও বাড়ানো হবে। যদি কাউকে গ্রেফতার করা হয় তার বা তাদের বিরুদ্ধে প্রতারণা, পাবলিকেশনস ও আইসিটি অ্যাক্টে মামলা হবে।’
/এআরআর/ টিএন/