জঙ্গিদের ল্যাবরেটরি ও স্টোরহাউজ

চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও ঝিনাইদহের জঙ্গি আস্তানাসাম্প্রতিক সময়ে ঝিনাইদহ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে দু’টি জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালিয়েছে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। ঝিনাইদহের আস্তানাটি বিস্ফোরক তৈরির ল্যাবরেটরি হিসেবে ব্যবহার করত জঙ্গিরা। আর চাঁপাইনবাবগঞ্জের আস্তানাটিতে তারা ওইসব বিস্ফোরক মজুদ করে চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করত। অর্থাৎ, এই আস্তানাটিকে তারা ব্যবহার করত স্টোরহাউজ হিসেবে।

শনিবার (২৯ এপ্রিল) সিটিটিসি প্রধান মনিরুল ইসলাম ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান।

মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘আপনারা জানেন যে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে গত দুই সপ্তাহে ঝিনাইদহ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে পৃথক দু’টি জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালানো হয়েছে। ঝিনাইদহের জঙ্গি আস্তানাটিতে অভিযানের পর বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক পাওয়া যায়। তবে সেখানে কোনও জঙ্গি পাওয়া যায়নি। ওই বাড়িটি ভাড়া নিয়েছিল আব্দুল্লাহ নামের একজন। সে পালিয়ে গিয়েছিল। আস্তানাটিকে জঙ্গিরা বিস্ফোরক বানানোর ল্যাবরেটরি হিসেবে ব্যবহার করত। অন্যদিকে, গত বুধবার (২৬ এপ্রিল) চাঁপাইনবাবগঞ্জের একটি জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালায় সিটিটিসি। এই আস্তানাটিকে জঙ্গিরা বিস্ফোরকের স্টোরহাউজ হিসেবে ব্যবহার করত। এখান থেকে তারা চাহিদা অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিস্ফোরক সরবরাহ করত।’

মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘এই আস্তানাটি জঙ্গিদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই আস্তানায় পাওয়া বিস্ফোরকগুলো এখানে বানানো নয়। আমাদের মনে হয়েছে, এগুলো বাইরে থেকে নিয়ে আসা। যে দু’জন বাইরে থেকে ওই আস্তানায় গিয়েছিল, তারাও এগুলো নিয়ে যেতে পারে।’

মনিরুল ইসলাম আরও বলেন, ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জের অভিযানে চার জঙ্গি নিহত হয়েছে। বাড়িটি ভাড়া নিয়েছিল রফিকুল ইসলাম আবু। এছাড়া, ঝিনাইদহের আস্তানা থেকে পালিয়ে আসা আব্দুল্লাহও ছিল।’

চাঁপাইনবাবগঞ্জের ‘অপারেশন ঈগল হান্ট’ অন্য জঙ্গি আস্তানাগুলোয় পরিচালিত অভিযানের চেয়ে ভিন্ন উল্লেখ করে সিটিটিসি প্রধান বলেন, ‘এই অভিযানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো—এখানে শেষ সময় পর্যন্ত জঙ্গিদের আত্মসমর্পণ করানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কারণ সেখানে নারী ও শিশু ছিল। নারী-শিশু না থাকলে এই অভিযানে আরও কম সময় লাগত। তারা যেন আত্মসমর্পণ করে, সেজন্য অনেক আলোচনা হয়েছে। পরে এক শিশুসহ এক নারী আত্মসমর্পণ করেছে। অন্য জঙ্গিদেরও আত্মসমর্পণের জন্য বলা হয়েছিল। তারা তাতে সাড়া দেয়নি।’

জঙ্গি আবু ও জঙ্গি আব্দুল্লাহজঙ্গিরা কিভাবে মারা গেছে, এ প্রসঙ্গে মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘জঙ্গিরা নিজেদের বিস্ফোরণে নাকি গুলি বিনিময়ের সময় মারা গেছে, তা ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন প্রকাশের পর নিশ্চিত হওয়া যাবে। তবে আমরা ধারণা করছি, তাদের দু’জন নিজেদের বিস্ফোরণে ও দু’জন গুলি বিনিময়ে নিহত হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘অভিযানের সময় জঙ্গিরা অনেকগুলো বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। আস্তানা থেকে চারটি বোমা, ভেস্ট ও পিস্তল উদ্ধার করা হয়েছে। এই পিস্তল দিয়েই তারা ২৬ তারিখ পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছিল।’

মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘আবুর স্ত্রী সুমাইয়া খাতুন নব্য জেএমবির সঙ্গে জড়িত। সে ও তার শিশু সন্তান আহত হওয়ায় তারা হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে। এই অভিযানে আমাদের কেউ আহত হয়নি।’ ঝিনাইদহ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের আস্তানায় দু’টি ঘাঁটিই নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে জানিয়ে সিটিটিসি প্রধান বলেন, ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জের অভিযানে জেলা পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, মেডিক্যাল টিম, গোয়েন্দা সংস্থাসহ সবার সহযোগিতা ছিল।’

এক প্রশ্নের জবাবে মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘গত বছর ১ জুলাই গুলশান হামলার পর শোলাকিয়ার হামলাটি ছিল জঙ্গিদের বড় ধরনের একটি হামলার ঘটনা। এরপর তারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আস্তানা তৈরি করছে। বিস্ফোরক তৈরি করেছে, তা মজুদ করেছে নাশকতার জন্যই। তারা দেশব্যাপী হামলা না চালাতে পারলেও হয়তো বিভিন্ন স্থানকে টার্গেট করে হামলা চালানোর পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু আমাদের আগাম গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে একের পর এক অভিযানে জঙ্গিরা নাশকতার পরিকল্পনাগুলো বাস্তাবায়ন করতে পারেনি। তারপরও তারা ঢাকাতে বিমানবন্দরের পাশে একটি দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। সিলেটে আমাদের তিন জন অফিসারসহ চার জন মারা গেছেন। যেসব আস্তানায় বিস্ফোরক ছিল, সেগুলো ছিল টার্গেট-বেজড।’

বাড়িওয়ালাদের অসহযোগিতা ও দায়িত্বে অবহেলার বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এসব ঘটনা কেস টু কেস ভেরি করে। আমাদের অনেক বাড়িঅলা সহযোগিতা করেছে, তথ্য দিয়েছে। আবার যেসব বাড়িঅলা অসহযোগিতা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’

জঙ্গিদের আত্মঘাতী হওয়ার প্রবণতা প্রসঙ্গে মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘তাদের আত্মঘাতী হওয়ার প্রবণতার অন্যতম কারণ হলো—তাদের সবসময় কোরআন-হাদিসের ভুল ও বিকৃত ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। তাদের বলা হয়, তারা মরলে সরাসরি জান্নাতে যাবে। এমনকি তারা আত্মহত্যা করলেও জান্নাতে যাবে। তাদের ভাষায় মুরতাদ বাহিনী (আইনশৃঙ্খলা বাহিনী) যখন ঘিরে ফেলবে, তখন এই বাহিনীর কোনও সদস্যসহ মারা গেলে তারা জান্নাতে যাবে। আর ওই বাহিনীর কাউকে না মারতে পারলেও নিজেরা আত্মহত্যা করলেও জান্নাতে যাবে। এমন ব্যাখ্যা দিয়েই জঙ্গিদের আত্মঘাতী হামলায় উৎসাহিত করা হয়। সে কারণেই তারা আত্মঘাতী হওয়ার প্রবণতা তৈরি হচ্ছে।’

ঝিনাইদহের জঙ্গি আস্তানা থেকে উদ্ধার করা রাসায়নিক ভর্তি ড্রামমনিরুল ইসলাম বলেন, ‘আর কোথাও যে আস্তানা নেই, তা বলা যাবে না। আরও আস্তানা থাকতে পারে। অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও কাজ করছে। গোয়েন্দা বাহিনী কাজ করছে। জনগণ আমাদের সহযোগিতা করছে। আমরা স্থানীয়দের সহযোগিতা পাচ্ছি। এই জঙ্গিবাদ মোকাবেলা মানবতাবাদী কাজ। সবার সহযোগিতা নিয়ে একে মোকাবিলা করতে হবে। এটা পুলিশের একার কাজ না।’

অন্য এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় সব মন্ত্রণালয় কাজ করছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন কাজ করছে। ইমামদের নিয়ে তারা সভা করছে। জুমার দিনে ইমামরা তাদের বয়ানে জঙ্গিবাদ নিয়ে কথা বলছেন। মাওলানারা কথা বলছেন। ফরিদ উদ্দিন মাসুদ এক লাখ আলেম নিয়ে ফতোয়া দিয়েছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় কাজ করছে। আমরা পুলিশ সবার সঙ্গে সমন্বয়ের কাজটি করছি।’

জঙ্গিদের অর্থায়ন প্রসঙ্গে মনিরুল বলেন, ‘ঝিনাইদহের জঙ্গি আস্তানাটি আব্দুল্লাহ জঙ্গি সংগঠনের টাকায় কিনেছে। যারা হিজরতে থাকে, তারা তাদের সম্পত্তি জঙ্গি কার্যক্রমে দান করে। জঙ্গিদের সমমনা চাকরিজীবীরাও অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করে। কেউ কেউ বিদেশ থেকেও টাকা পাঠাচ্ছে।’

জঙ্গিবাদে দেশের কোনও রাজনৈতিক দলের ইন্ধন আছে কিনা, জানতে চাইলে সিটিটিসির প্রধান বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক বা ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে আমরা তথ্য সংগ্রহ করি। চাঁপাইনবাবগঞ্জে যে আবু মারা গেছে তার বাবা ও শ্বশুরের পরিবার জামায়াত। তাই এটি কেস টু কেস ভেরি করে। এই অভিযোগ একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। আমরা এখন পর্যন্ত জঙ্গিদের সব উৎস জানতে পারিনি।’

নতুন নতুন নারী-পুরুষ জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার বিষয়ে মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘কেউ ভাইয়ের মাধ্যমে, কেউ বাবার মাধ্যমে, কেউ বন্ধুর মাধ্যমে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে যাচ্ছে। আবু তার পরিবারের মাধ্যমেই জঙ্গিবাদে জড়িয়েছে।’

আরও পড়ুন-
স্ত্রীর হাত ধরেই জঙ্গিবাদে জড়ায় আবু আলী

চার জঙ্গির ময়নাতদন্ত সম্পন্ন, আবুর লাশ হস্তান্তর

বেওয়ারিশ হিসেবেই শিবনগরের চার জঙ্গির লাশ দাফন

/এআরআর/টিআর/টিএন/