ঢাকার খাল কাগজে আছে, বাস্তবে নেই




ফলক থাকলেও খিলগাঁও-বাসাবো খালের অস্তিত্ব নেই

রাজধানীর খিলগাঁও রেলগেট ফ্লাইওভার সংলগ্ন ফার্নিচার দোকানগুলোর সামনে খিলগাঁও-বাসাবো খালের নাম সম্বলিত ঢাকা ওয়াসার একটি ফলক রয়েছে। এতে খাল দখলমুক্ত রাখতে সচেতনতামূলক বিভিন্ন কথা লেখা রয়েছে। তবে ফলকটির আশপাশের কোথাও খালের কোনও অস্তিত্ব নেই।

স্থানীয় দোকানি ইব্রাহীম হোসেন জানান,তার দোকানটিই এই খালের ওপর। তিনি দোকানের মালিক নন। কয়েক বছর আগে স্থানীয় প্রভাবশালীরা খালটি ভরাট করে বহুতল ভবন গড়ে তুলেছেন। এ খালটি খিলগাঁওয়ের ভেতর দিয়ে বাসাবো হয়ে মাণ্ডা খালের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। ওয়াসার নথিপত্রে খালটির প্রস্থ স্থানভেদে ৫-১০ মিটার।


রাজধানীর শেরে-বাংলা নগরস্থ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পশ্চিমাংশ হয়ে মাহবুব মোরশেদ সরণী দিয়ে কল্যাণপুর প্রধান খাল পর্যন্ত বিস্তৃত কল্যাণপুর ‘চ’ খাল। কাগজে এ খালের দৈর্ঘ্য এক হাজার ১২০ মিটার। প্রস্থ ১৮ মিটার হলেও বাস্তবে রয়েছে মাত্র ৭ মিটার। সিটি করপোরেশনের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, খালটিতে অবৈধ স্থাপনা রয়েছে ৬৫০ বর্গমিটার। পুরো খালের ৮৪০ মিটার ময়লা-আবর্জনায় ভরা। তাই পানি প্রবাহ বন্ধ রয়েছে। ফলে বৃষ্টি হলেই পুরো এলাকায় জলাবদ্ধতার দেখা দেয়। 
শুধু এ খাল দুটি নয়,রাজধানীর ৪৬টি খালের মধ্যে বর্তমানে ঢাকা ওয়াসার নথিতে ২৬টি খালের অস্তিত্ব রয়েছে। বাকি ২০টি খাল বিলীন হয়ে গেছে। নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, খালের সংখ্যা ছিল ৫২টি। এখন যে ২৬টি খালও আছে তাও রয়েছে অস্তিত্ব সংকটে। যে কারণে সামান্য বৃষ্টি হলেই পুরো নগরজুড়ে তীব্র জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়।
জলাবদ্ধতার মূলকারণ নিয়ে ঢাকার সম্প্রতি খালগুলো নিয়ে একটি সচিত্র প্রতিবেদন তৈরি করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। এতে দেখা গেছে, ঢাকা মহানগরীতে খালের সংখ্যা ৪৩টি। এর মধ্যে ঢাকা ওয়াসার রক্ষণাবেক্ষণ করে ২৬টি। ৯টি খাল রাস্তা,বক্সকালভার্ট ও ব্রিক স্যুয়ারেজ লাইনে পরিবর্তন করা হয়েছে। বাকি ৮টি খাল রয়েছে জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে।
১৬ জুলাই নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে ডিএনসিসির আন্তঃবিভাগীয় সমন্বয় সভায় ‘ঢাকায় জলাবদ্ধতার কারণ এবং রাজধানীর খালগুলোর বর্তমান অবস্থা’ নিয়ে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়। প্রতিবেদনটি তৈরি করেন ডিএনসিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শরীফ উদ্দিন।
প্রতিবেদনে দেখা গেছে,বিদ্যমান খালগুলোর মধ্যে রামচন্দ্রপুর খাল ১০০ ফুটের জায়গায় ৬০ ফুট, মহাখালী খাল ৬০ ফুটের জায়গায় ৩০ ফুট,প্যারিস খাল ২০ ফুটের স্থলে ১০-১২ ফুট,বাইশটেকি খাল ৩০ ফুটের স্থলে ১৮-২০ ফুট,বাউনিয়া খাল ৬০ ফুটের বদলে ৩৫-৪০ ফুট,দ্বিগুণ খাল ২০০ ফুটের বদলে ১৭০ ফুট,আবদুল্লাহপুর খাল ১০০ ফুটের বদলে ৬৫ ফুট,কল্যাণপুর প্রধান খাল ১২০ ফুটের স্থলে স্থানভেদে ৬০ থেকে ৭০ ফুট,কল্যাণপুর ‘ক’ খালের বিশাল অংশে এখন সুরু ড্রেন,রূপনগর খাল ৬০ ফুটের স্থলে ২৫ থেকে ৩০ ফুট,কাটাসুর খাল ২০ মিটারের বদলে ১৪ মিটার,ইব্রাহিমপুর খালের কচুক্ষেত সংলগ্ন মাঝামাঝি স্থানে ৩০ ফুটের স্থলে ১৮ ফুট রয়েছে। এসব খালের অধিকাংশ স্থানে প্রভাবশালীরা দখল করে বহুতল ভবন,দোকানপাট ও ময়লা অবর্জনায় ভরাট করে রেখেছে। ফলে খালে পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক জায়গায় বিলীন হয়ে গেছে অস্তিত্ব।
রামচন্দ্রপুর খাল শুরু নবোদয় প্রধান সড়কের ৮ নং রোড থেকে। খালটির এ অংশ থেকে ৬০০ মিটার পর ওয়াসা পাম্প সংলগ্ন অংশে অবৈধ বহুতল স্থাপনা নির্মাণ ও ময়লা আবর্জনার স্তূপ জমে আছে। এ খাল পাড়ের ৩০ ফুট জায়গা ভরাট করে রাস্তা তৈরি করেছে সিটি করপোরেশন। এছাড়া নবোদয় প্রধান সড়কের ১০নং রোডস্থ সুনিবিড় হাউজিং বিশাল অংশ দখল করে স্থাপনা তৈরি করেছে।
ডিএনসিসির ৩৩ ও ৩৪ নং ওয়ার্ডের বিশাল অংশ জুড়ে কাটাসুর খালের অবস্থান। এ খালটির দৈর্ঘ্য এক হাজার ৭১৫ মিটার। বর্তমানে খালের শুরুর অংশে ১৪ মিটার এবং শেষাংশে ২০ মিটার প্রস্থ রয়েছে। ১৫০ বর্গমিটার জুড়ে গড়ে উঠেছে অবৈধ স্থাপনা। তাছাড়া এক হাজার ৫৪৫ মিটার অংশ ময়লা ও আবর্জনায় ভরা। এ খালটির ১৬৫/৫, পুলপার ৬৭/৫ পশ্চিম কাটাসুর, ২৫২/১ বসিলা রোড, বেড়িবাঁধ রোড কালভার্ট, মোহাম্মদপুর হাউজিং, নবোদয় হাউজিং ও ৩ নং রোড কালভার্টের দক্ষিণ পাশে খালের মধ্যে একটি মসজিদ ও একটি গির্জা গড়ে ‍উঠেছে। এসব এলাকায় ৬০ ফুট প্রস্থের স্থলে ৩০ ফুট রয়েছে।
কসাইবাড়ী খালের অস্তিত্বই নেই। উত্তরার দক্ষিণ আজমপুর থেকে শুরু হয়ে কসাইবাড়ী হয়ে মোল্লারটেক পর্যন্ত বিস্তৃতি ছিল এ খালটির। এখন এটি পরিণত হয়েছে ড্রেনে। এর দৈর্ঘ্য ছিল আট হাজার মিটার এবং প্রস্থ ১০ থেকে ১২ মিটার আছে।
কল্যাণপুর ‘খ’ খাল কাগজে-কলমে ৪০ ফুট হলেও অনেক জায়গায় খালের কোনও অস্তিত্ব নেই। কোনও কোনও জায়গায় ৯-১২ মিটার দেখা গেছে। কোথাও কোথাও ময়লা আবর্জনা ভরে প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। এ খালটির দৈর্ঘ্য দুই দশমিক ৪০ কিলোমিটার।
শীতলক্ষ্যা নদী হতে উৎপন্ন হয়ে ক্রমশ সরু হয়ে ঘোপদক্ষিণ মৌজার পশ্চিমপ্রান্তে বাওয়ানী জুট মিলের ভেতরে গিয়েছিল ঘোপদক্ষিণ খাল। এ খালটির বর্তমানে কোনও অস্তিত্ব নেই। খালটি অধিগ্রহণ করে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয় লতিফ বাওয়ানী জুট মিলস তৈরি হয়েছে।
প্রতিবেদনে জলাবদ্ধতা দূর করতে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য খালের উপর নির্মিত অবৈধ স্থাপনা অপসারণ,প্রকৃত সীমানা নির্ধারণ,বিলীন হওয়া খাল উদ্ধার,পুনঃখনন ও বর্ষা মৌসুমের আগে খাল পরিষ্কার করতে হবে।
এ বিষয়ে কথা বলতে বারবার চেষ্টা করেও মেয়র আসিনুল হককে পাওয়া যায়নি। তবে চলতি মাসের ১৬ তারিখে জলাবদ্ধতা নিয়ে ডিএনসিসির এক সমন্বয় সভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতায় স্থায়ীয় সরকার মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন ওয়াসা থেকে নিয়ে ঢাকার খালগুলো সিটি করপোরেশনকে দেওয়ার ঘোষণা দেন। তখন ‍ডিএনসিসির মেয়র আনিসুল হক বলেন,‘আমরা তো খাল নিতে চাই। কিন্তু ওয়াসার খালতো বিকলাঙ্গ রোগী। রোগী ভালো করে বাচ্চা আমাদেরকে দিয়ে দেন।’
এ বিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,‘পানি নিষ্কাশনের দুটি পথ রয়েছে। প্রথমত ভূ-গর্ভে পানি শোষণ করে নেওয়া এবং অন্যটি খাল বিল ও ড্রেন দিয়ে নদীতে চলে যাওয়া। রাজধানী ঢাকায় এই দুটি পথের একটিও কার্যকর নেই। যে কারণে জলাবদ্ধতা বাড়ছে। এ থেকে মুক্তি পেতে হলে জনগণকে সম্পৃক্ত করে পরিকল্পিত উপায়ে খাল উদ্ধার করতে হবে।’
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ঢাকার জন্য জলাবদ্ধতা বড় একটি সমস্যা। আমরা বিভিন্ন খাল উদ্ধারে বিভিন্ন সময় অভিযান করেছি। নন্দীপাড়া খালের ওপর স্থাপিত মার্কেট ভেঙে দিয়েছি। কিন্তু দখল হওয়া কিছু কিছু স্থাপনায় উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা আছে। আমরা আইনিভাবে সেগুলো মোকাবিলার চেষ্টা করছি।’
/এসএস/এসটি/

আরও পড়ুন: 

যানজট-জলজট আর গণপরিবহনের সংকটে নগরজুড়ে ভোগান্তি