অপারেশন টেবিলে ছেলে, প্রার্থনায় মা

ছেলের জন্য প্রার্থনা করছেন মা সুলেমা খাতুনশুক্রবার (৪ আগস্ট) ছেলের অপারেশন, তারিখ আগে থেকে জানা থাকলেও সময়টা নির্ধারিত ছিল না। সকালেই সেটি কনফার্ম হয়েছে। আর তখন থেকেই জায়নামাজে বসেছেন মা সুলেমা খাতুন। হাত তুলেছেন সৃষ্টিকর্তার কাছে। একটাই চাওয়া, ছেলের বাম চোখের দৃষ্টিটা যেন ফিরে আসে।

পুলিশের ছোড়া কাঁদানে গ্যাস ও লাঠির আঘাতে গুরুতর আহত কলেজছাত্র সিদ্দিকুরের মা সুলেমা খাতুনের সঙ্গে শুক্রবার দুপুরে দেখা করতে গেলে এমনটাই দেখা যায়।বর্তমানে রাজধানীর মিরপুরে এক আত্মীয়ের বাসায় অবস্থান করছেন তিনি। সিদ্দিকুর গত ২৭ জুলাই চেন্নাই যাওয়ার পর থেকেই মা সুলেমা খাতুন ছিলেন তিতুমীর কলেজের পাশেই ছেলের এক বন্ধুর পরিবারের সঙ্গে। গত পরশু সেখান থেকে চলে আসেন মিরপুরে এক আত্মীয়ের বাড়িতে।

সেখানেই তার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।  দেখা যায়, ছেলের চোখের আলো ফিরে পাবার আশায় সকাল থেকেই জায়নামাজে বসেছেন সুলেমা খাতুন।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সিদ্দিকুর রহমান। বেডের পাশে বসে আছেন তার মা4ছেলে চেন্নাই যাবার আগে মাকে বলে গিয়েছিল, ‘আল্লাহ যা করেন সব ভালোর জন্য করেন। আমি কোনও অন্যায় করিনি।’ আর আমি তো মা, মায়ের মনতো বলতেছে ছেলে আমার সুস্থ হয়ে যাইবো, চোখে দেখতে পাইবো। আমার ছেলেও আমারে বলে গেছে, সে চোখে দেখতে পাইবো, ছেলে কোনোদিন আমার সঙ্গে মিথ্যা বলে নাই, এখনও বলবে না। আমার ছেলে নিশ্চয়ই চোখের আলো নিয়ে ফেরত আসবে।’ বলতে বলতে সুলেমা খাতুন শব্দ করে কেঁদে ওঠেন। একসময় কান্না থামে,  আবার বলেন, ‘‘ছেলের সঙ্গে গত ২ তারিখে (আগস্ট) কথা হইছে। বলছে, ‘আম্মা তুমি চিন্তা কইরো না। যা করার আল্লাহ তাই করবে, এখানে মানুষের কোনও হাত নাই।’ পুতে যখন একথা কইতেছিল গলাডা জানি কেমন ছিল তখন, কিন্তু আমি শক্ত ছিলাম। আমার বাজানরে কইছি বাবা,তুমি কাইন্দো না, তুমি ভালা হইয়া যাবা। এখন বাকিডা আল্লাহ জানে।’’ 

সুলেমা খাতুনের আত্মীয় পুতুল বলেন, ‘গতকাল (বৃহস্পতিবার) রাত থেকে কেবল কেঁদেই চলেছেন। জায়নামাজ থেকে প্রয়োজন ছাড়া একবারের জন্যও ওঠেননি।তার একটাই কথা, খোদা যেন সিদ্দিক মামার বাম চোখের আলো ফিরিয়ে দেন।’

এ প্রতিবেদকের সঙ্গে থাকা সিদ্দিকুরের বন্ধু শাহ আলী এ সময় বলেন, ‘চেন্নাইয়ের চিকিৎসকরা সিদ্দিকুরের বাম চোখের দৃষ্টি না ফেরার বিষয়ে যে জানিয়ে দিয়েছেন, সেটাতো উনি জানেন না। উনি জানেন অপারেশন করলেই ছেলের চোখ ভালো হয়ে যাবে। আমরা তো তাকে জানাইনি এমনকি সিদ্দিক কিংবা নওয়াব ভাইও (সিদ্দিকুরের বড় ভাই) তাকে এ বিষয়ে কিছুই জানান নাই। ছেলে অপারেশনের জন্য চেন্নাই গেছে কত আশা নিয়ে, সেদিন মা কত আশা নিয়ে ছেলেকে বিদায় জানালো, এখন কী করে তাকে এ কথা আমরা জানাই।ছেলের চোখের আলোর জন্য সবসময় কেবল আল্লাহর কাছে দোয়া চাইছেন তিনি।’

সিদ্দিকুরের মা সুলেমা খাতুন সুলেমা খাতুন বলেন,‘ছেলে-মেয়েদের বড় করতে সব মায়ের কষ্ট হয়। কিন্তু সিদ্দিকুরের বাবাতো তার তিন বছর বয়সেই মারা গেছে, বড় ছেলে নওয়াব আলী স্কুল পাস (মাধ্যমিক)করে কলেজে উঠে আর পড়তে পারেনি। সে রড মিস্ত্রির কাজ করে। আমি ছাগল, মুরগি-হাঁস পেলে সিদ্দিকুরকে লেখাপড়া শিখাইছি। সবারই কষ্টের পরে সুখ আসে। আমাদের আশা ছিল, আমার এই ছোট ছেলে অফিসার হলে আমাদের সুখের দিন আসবে। কিন্তু সুখের দেখাতো আর পাইতাছি না মা। সামনে যে কেবলই আমাদের দুঃখের দিন।’

সরকার সিদ্দিকুরকে চাকরি দেবে বলে ঘোষণা দিয়েছে জানালে তিনি বলেন, ‘চোখ যদি না থাকে তাহলে আমার পোলাডা কেমনে চাকরি করবো, ওর যে চোখের অপারেশনটা ঠিক হওয়া আমাদের জন্য বাঁচা মরার লড়াই ।’

এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সময়েই সুলেমা খাতুনের ফোনে কল আসে। কথা বলা শেষ হলে কে ফোন করেছিল জানতে চাইলে বলেন, ‘সব আত্মীয়রা আমারে ফোন দেয়, সিদ্দিকুরের কথা জানতে চায়। কিন্তু আমি তো কোনও খবর জানি না, সবাই আমারে সত্য কথা বলে কিনা সেটা নিয়াও আমার সন্দেহ আছে।’

তবে আমি আমার কাজ করে যাচ্ছি, সারারাত ঘুমাইছি না। আল্লাহর কাছে কই-আমার পুতের একটা চোখ ফিরাইয়া দাও।  এক মায়ের কথা কি খোদা শুনবো  না? মায়ের চোখের পানি কি খোদার দরবারে পৌঁছাবে না?’ প্রশ্ন করে তিনি নিজেই বলেন, ‘অবশ্যই আমার কথা খোদা শুনবেন। আমার ছেলে চোখের আলো নিয়ে ফেরত আসবে। সিদ্দিকুর আমারে যে সেই কথাই দিয়ে গেছে।’

এদিকে, শুক্রবার দুপুর সাড়ে তিনটায় সিদ্দিকুরের অপারেশন শুরু হয়ে সন্ধ্যা ৬টায় শেষ হয়েছে।  বাংলা ট্রিবিউনকে এ তথ্য জানিয়েছেন সিদ্দিকুরের সহপাঠী ও বন্ধু শেখ ফরিদ। যদিও শংকর নেত্রালয়ের চিকিৎসকরা সিদ্দিকুরের বাম চোখের দৃষ্টি ফিরবে না বলেই  মতামত দিয়েছিলেন। জানিয়েছিলেন দৃষ্টি ফেরার সম্ভাবনা শতকরা এক শতাংশ, প্রায় নেই বললেই চলে। তারা বিষয়টি ছেড়ে দিয়েছিলেন রোগী সিদ্দিকুরের ওপরে। সিদ্দিকুর অপারেশন করতে চান জানানোর পর আজ তার অপারেশন করার সিদ্ধান্ত হয়।

সিদ্দিকুরের বন্ধু শেখ ফরিদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, শংকর নেত্রালয়ের চিকিৎসক লিঙ্গম গোপাল এই অপারেশন করছেন বলে আমাদের জানিয়েছেন সিদ্দিকুরের সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. জাহিদুল এহসান মেনন।

উল্লেখ্য, পরীক্ষার রুটিন ও তারিখ ঘোষণাসহ কয়েকটি দাবিতে গত ২০ জুলাই শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হওয়া নতুন সাতটি সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা। এ সময় শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠিচার্জ ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে পুলিশ। এ ঘটনায় গুরুতর আহত হন তিতুমীর কলেজের ছাত্র সিদ্দিকুর রহমান।

এরপর জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সিদ্দিকুরের ডান চোখে আলো ফেরার সম্ভাবনা নেই ও বাম চোখের অবস্থাও ভালো না বলে জানান দেশের ডাক্তাররা। পরে তার চোখের চিকিৎসার ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের তত্ত্বাবধানে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসরা তাকে চেন্নাইয়ের শংকর নেত্রালয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠান।

/এপিএইচ/

আরও পড়ুন:

সিদ্দিকুরের অপারেশন শুরু