প্রবাসী নারীদের ফাঁদে ফেলা এক প্রতারকের কাহিনি

প্রতারকমিনা (ছদ্মনাম)। জীবিকার তাগিদে গৃহকর্মীরকাজ নিয়েছিলেনমধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরবে। সেখানে গৃহকর্তাসহ একাধিক পুরুষের নিপীড়নের শিকার হন তিনি। বিষয়টি নিয়ে কমিউনিটির কাছে বিচার চাইতে গেলে পড়েনবাড়ির মালিকের রোষানলে। এ কারণে সেখানকার কারাগারে পর্যন্ত যেতে হয়েছিল তাকে।

মিনা’র জীবনের দুঃস্বপ্নের গল্প এখানেই শেষ নয়। বাংলাদেশের বেসরকারি একটি টিভি চ্যানেলের উপস্থাপক আহসান হাবিব পেয়ারকে কেন্দ্র করে গড়িয়েছে তা। এই উপস্থাপক ‘এএইচপি’ টিভি নামে একটি চ্যানেলের মালিক! পিস টিভি বন্ধ হওয়ার পরপরই সে নিজের নামে চ্যানেলটিখুলেছে। ভণ্ডামি করে মিনা’র মতো অনেক প্রবাসী গৃহিণীকে প্রতারিত করেছে সে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্র্যান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের সাইবার ক্রাইম অ্যান্ড সিকিউরিটি টিমের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মো. নাজমুল আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে দাওরায়ে হাদীস সম্পন্ন করে আহসান হাবিব পেয়ার। তাকে গ্রেফতার করে দুই দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তার কাছ থেকে মানুষের সঙ্গে বিভিন্ন উপায়েকরা প্রতারণার ভয়ঙ্কর তথ্য পাওয়া গেছে।’

এছাড়া ডজনখানেক প্রতারিত ব্যক্তির কাছ থেকে মৌখিকভাবে প্রতারণার অভিনব কৌশল সম্পর্কে জানতে পেরেছে পুলিশ। যাদের বেশিরভাগই পারিবারিক ও সামাজিক মান সম্মানের ভয়ে লিখিত অভিযোগ দিতে চাননি। তবে একাধিক ভুক্তভোগী আর সহ্য করতে না পেরে আহসান হাবিব পেয়ারের পেয়ারের বিরুদ্ধে খিলগাঁও থানায় মামলা করেছেন। অতিরিক্ত উপ-কমিশনার জানান, একটি মামলা তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায়, অন্যটি হয়েছে প্রতারণার অভিযোগে।এএইচপি টিভি চ্যানেলের অনুমোদন না থাকায় এবং এধরনের একটি চ্যানেল দিয়ে মানুষকে প্রতারণার ঘটনায় আইসিটি অ্যাক্টে এবং পর্ণ উৎপাদনের ঘটনায় আরও একটি মামলা হয়েছে।

প্রতারণার আশ্রয় নিতে পেয়ার নিজেরটিভি চ্যানেলে বেশকিছু ভিডিও আপলোড করে।এছাড়া ফেসবুকে ওইসব ভিডিও পোস্ট করে অসংখ্য মানুষের বন্ধু হয়। তার নামে ইউটিউব চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা ছাড়িয়েছেকোটির ঘর।ফেসবুকে দেওয়া তারঅনেক পোস্টে লাইকের সংখ্যা ৩০ থেকে ৪০ হাজার পর্যন্ত ছাড়িয়ে যেতে দেখা গেছে।

এই জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য পেয়ারকে খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়নি। দেড় বছর আগে রোহিঙ্গা সমস্যাকে পুঁজি করে সে। ঘটনাস্থলে গিয়ে এক রোহিঙ্গা মুসলিম শিশুকন্যার ছবি তুলে পোস্ট করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। পোস্টে সে উল্লেখ করেন, ‘কুকুরের মতো হত্যা করা হচ্ছে মুসলিম বোনদের।’ তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য অর্থ সহায়তা দেওয়ার আহ্বানও জানায় সে। ওই পোস্ট একপর্যায়ে ভাইরাল হয়ে যায়। এটি দেখেই ফাঁদে পড়েন অনেকে।

প্রবাসী মিনা সেইপ্রতারিতদেরই একজন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “ওই ছবি দেখেছি সৌদি আরবের কারাগারে। ওই অবস্থাতেই আমার মন ভারি হয়ে ওঠে। নুরানি চেহারার একজন আলেমের এমন উদ্যোগের পাশে দাঁড়ানোর জন্য পাঁচ হাজার টাকা পাঠানোর প্রক্রিয়া জানতে চাই। এজন্য তার ফেসবুকে কমেন্ট করি। সে তখন ইনবক্সে আসে। আমাকে আম্মা সম্বোধন করে বিকাশ নম্বর দেয়। টাকা পাঠানোর পর ইমোতে আমার চেহারা শনাক্তের জন্য ছবি দিতে বলে। ছবি দেখার পরপরই আমার সৌন্দর্যের প্রশংসা শুরু করে। সূরা আর আয়াত বলতে থাকে। একপর্যায়ে বলে বসে, ‘আপনি তো আমার আম্মা হতে পারেন না। আমি আপনার রূপে পাগল হয়ে গেছি!’এভাবে ফাঁদে ফেলেইমো ও ভাইবারে আমার আপত্তিকর ছবি নেয় সে। তারপর ব্ল্যাকমেইল করে কয়েক দফায় চার লাখ টাকানিয়েছে।”

গোয়েন্দা কর্মকতারা জানান, পেয়ারের কারণে ভুক্তভোগী হয়েছেন এমন অন্তত ডজনখানেক নারীকেপাওয়া গেছেযারা সবাই গৃহিণী এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের প্রবাসী কর্মচারী। এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একজন নারী সদস্য এবংনামি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের স্ত্রীওতার ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয়েছেন।

তদন্ত সূত্র জানায়, পেয়ারের কাছ থেকে তিনটি বিকাশ নম্বর উদ্ধার করা হয়েছে। পাওয়া গেছেপাঁচটি বিভিন্ন ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট নম্বর। এগুলো হলো- ইসলামি ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, ডাচ-বাংলা ব্যাংক, আল আরাফা ইসলামী ব্যাংক ও সরকারি অগ্রণী ব্যাংক। এসব অ্যাকাউন্টে ১০ কোটি টাকা ঢুকেছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। এখন এ বিষয়েবিস্তারিত তথ্য যাচাই করা হচ্ছে।গোয়েন্দারা জানান, প্রতি মাসে ১ থেকে ২ লাখ টাকা খরচ করতোসে। বিনিময়ে তার আয় হতো মাসেঅন্তত ৪০ থেকে ৫০ লাখ টাকা।

সূত্র জানায়, রাজধানীর খিলগাঁওয়ের তিলপা পাড়ায় ২২ নম্বর রোডেরসাবেক কমিশনার কাজল সরকারের পাঁচ তলা ভবনের পঞ্চম তলার একটি ফ্ল্যাট থেকেগত ১ আগস্ট বিকাল ৫টায় পেয়ারকে গ্রেফতার করা হয়। পাঁচ তলায় একটি ফ্ল্যাটে সাবলেটে থাকে সে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থাকা ঘরটিতেদুটি ডেস্কটপ, একটি আলমারি ওদুটি খাট আছে। ওইভবনের ছাদে চিলেকোঠায় তার পর্ণ উৎপাদনের প্যানেল অফিস ছিল। সেখান থেকে দুটি সিপিইউ, দুটি মনিটর, চারটি বুম, ট্রাইপড, ক্যামেরা ও বাসার কম্পিউটারে সংরক্ষিত হাজার হাজার পর্ন ভিডিও উদ্ধার করা হয়েছে।যেসব ভিডিওর মধ্যে ৮ থেকে৯ জন গৃহিনী রয়েছেন।এসব আলামত নিয়ে সিআইডির ফরেনসিক পরীক্ষারপ্রক্রিয়া শুরু করেছেন তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

সিটিটিসির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার নাজমুল আলম বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করে জব্দ করা বিভিন্ন ডিভাইস থেকে বেশকিছু অফসিন উদ্ধার করা হয়েছে।গত ২ আগস্ট সাইবার ক্রাইম টিমের হেফাজতে পেয়ারকে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। শুরু থেকে সব ধরনের প্রতারণার কথা স্বীকার করেছে সে। প্রাথমিকভাবে অস্বীকারের চেষ্টা করলে পরে তার নগ্ন ছবি ও ভিডিও দেখানো হয় তাকে। তখন আর স্বীকার না করে পারেনি সে।

পেয়ারের বাড়িনোয়াখালীর চাটখিল থানারসিরাজভিলা গ্রামের বদলকোটে। তার বাবার নাম আনোয়ার উল্লাহ। তারা চার ভাই তিন বোন। সে সবার ছোট। তার বয়স ৩৫ বছরের বেশি হলেও সাংবাদিকদের কাছে সে নিজের বয়স বলেছে ২৮। আর পুলিশের কাছে বলেছে ২৪ বছর। সে গতরমজানে মাসব্যাপী ধর্মীয় একটি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বিভিন্ন অসহায় মানুষের ছবি ও ভিডিও পোস্ট করে ভার্চুয়াল মাধ্যমেঅসংখ্য মানুষের ভক্তি অর্জন করেছে পেয়ার।এ প্রসঙ্গে সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম টিমের উপ-কমিশনার মো. আলিমুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ধর্মীয় বিষয়কেন্দ্রিক পোস্টে অসংখ্য লাইকআর কমেন্ট দেখে ভার্চুয়াল জগতে কাউকেবিশ্বাস করার কোনওমানে নেই। বিশ্বাস করতে চাইলে বিভিন্ন মাধ্যমে যাচাই করে নিতে হবে। তবে এর বাইরেও বিভিন্নভাবে প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’

প্রতারিত গৃহিণীদের একজনবাংলা ট্রিবিউনকে জানান, তার স্বামী বিদেশ থাকেন। তিনি জানতে পারলে তার পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থান ভন্ডুল হয়ে যাবে।

সৌদি আরব থেকে আসা একজন নারী জানান, পেয়ারের পোস্ট করা একজন রোগীর ভিডিও দেখে প্রথম সৌদি আরব থেকে পাঁচ হাজার টাকা দেন তিনি। ওই নারী প্রথমে তারপোস্টে কমেন্ট করেছিলেন, ‘এই বাচ্চাকে আমি টাকা পাঠাতে চাই।’ তখন পেয়ার তাকে ইনবক্সে মেসেজ পাঠায়। বিকাশ নম্বর দেয়।এরপর ওই নারীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে সে।

অনলাইনকেন্দ্রিক এ ধরনের প্রতারণা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। এমন বৃদ্ধির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সাইবার ক্রাইমের কর্মকর্তারা বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, প্রত্যেক বছরে গড়ে ১, ২, ৪, ৮ ও ১৬, এমন হারে সাইবার ক্রাইম সংগঠিত হচ্ছে। এর কারণ জানিয়ে একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘সাইবার ক্রাইমের শিকার বেশিরভাগ ভুক্তভোগী আইনের আশ্রয় নিতে চান না। পারিবারিক ও সামাজিকভাবে বিপর্যস্ত হওয়ার আশঙ্কায় নিজেদের সর্বস্ব খুঁইয়েও আইনের আশ্রয় নিতে ভয় পান তারা। এ কারণে এসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড গোপনে আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে। এসব বিষয়ে বৃদ্ধি পায়নি সচেতনতাও।’

/এসএমএন/জেএইচ/আপ-এসএনএইচ/