২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার পর বিকালে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে দেখতে যাওয়া অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত বাংলা ট্রিবিউনকে এ তথ্য জানান। একই তথ্য জানান ঘটনার পরদিন সকালে ডা. প্রাণ গোপালের সঙ্গে যাওয়া আরেক চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলানও।
ঘটনার দিন বিকালে এবং তার পরদিন সকালে গিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতিকে কেমন দেখেছিলেন জানতে চাইলে এই চিকিৎসকরা বলেন, তিনি বির্মষ, চিন্তামগ্ন ছিলেন। কী চিন্তা করছিলেন তা জানি না, তবে মনে হয়েছিল, এই পৃথিবীতে যেন উনি আর নেই। হয়তো উনি ভাবতেই পারছিলেন না, কী ঘটনা ঘটে গেল, কারা মারা গেল। কারণ তখনও অনেক উড়োখবর আসছিল-সেসবই হয়তো ভাবছিলেন।
ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত বলেন, ‘ তারপর নেতা-কর্মীদের জন্য রক্ত যোগাড় করাসহ যা যা করতে হয় সব কিছুই করলাম, বাসায় ফিরলাম রাত ১২টার দিকে। পরদিন সকালে খবর দেওয়া হলো, আপা কানে কিছুই শুনছেন না। আমি তখন গেলাম, দেখে বললাম, কানের পর্দা ঠিক আছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও ইনার ইয়ারে (অর্ন্তকর্ণে) ইনজুরি হতে পারে, যাকে বলা হয় অ্যাকুইস্টিক ট্রমা বা শব্দজনিত আঘাত বা শব্দাঘাত। আমার চেম্বারে এনে হিয়ারিং টেস্ট করার কথা বললাম তাকে, কিন্তু তিনি বললেন, ‘আমি যাবো না।’ তারপর সুধাসদনের দ্বিতীয় তলায় সব মেশিন নিয়ে গিয়ে তাকে দেখলাম। হিয়ারিং টেস্ট করলাম, তাতে দেখলাম প্রধানমন্ত্রীর ডান কান প্রচণ্ডভাবে আঘাতপ্রাপ্ত, শ্রবণ ক্ষমতা কমে গেছে। আমি বললাম, এই মুহূর্তে যদি চিকিৎসা না করেন, তাহলে সেটা আরও বাড়তে থাকবে এবং এক পর্যায়ে গিয়ে সেটা ডেড হয়ে যেতে পারে। তখন কী চিকিৎসা করানো যাবে জানতে চান তিনি। আমি তাকে ওষুধসহ অন্যান্য কিছু চিকিৎসা পদ্ধতি দিয়ে বললাম, এগুলো করলে কানটা বেঁচে যাবে কিন্তু তাতেও ফিফটি ফিফটি চান্স রয়েছে। কিন্তু কিছু চিকিৎসা তখনও আমাদের দেশে নেই, বাইরে করাতে হবে বলে জানালাম। তখন তিনি আবার বলেন, ‘না-আমি যেতে পারবো না। আমার এতো শত শত নেতা-কর্মীকে রেখে আমি চিকিৎসায় যাবো না।’ তিনি আমার কাছে জানতে চান, ‘আমার একটা কান তো ভালো আছে?’ বললাম, ‘হ্যাঁ একটা ভালো আছে, কিন্তু আরেকটা চলে গেছে। তখন বললেন, ‘না- আমি যাবো না। কিন্তু ভাগ্য ভালো, কানের যতটুকু ইনজুরি হয়েছিল, আমি যে ওষুধ দিয়েছিলাম তাতেই কাজ হয়েছিল। এর মাসখানেক পরে তিনি সিঙ্গাপুরে যান, সঙ্গে আমিও যাই। সেখানে আমার করা হিয়ারিং টেস্টের সঙ্গে তাদের টেস্টের ফল পুরোটাই মিলে যায়। একবার তো প্রধানমন্ত্রী বলেই ফেললেন, ‘আমার প্রাণ গোপাল তো সাউন্ডপ্রুফ রুম ছাড়াও এরকমই পাইছে।’
সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকরাও বললেন, আর কিছু করার নেই। তখন দেশে ফিরে এলেন শেখ হাসিনা। এখনও তিনি ডান কানে একটু কম শোনেন, অকেশনালি হিয়ারিং এইডও ব্যবহার করেন।
তাকে সেদিন কেমন দেখেছিলেন জানতে চাইলে ডা. ইকবাল আর্সলান বলেন, ‘মানসিকভাবে তিনি খুব শক্ত ছিলেন, তবে নেতা-কর্মীদের মৃত্যুতে খুব ভারাক্রান্তও ছিলেন। তিনি কেবল আমাকে স্বাচিপের মহাসচিব হিসেবে গ্রেনেড হামলায় আহত হয়ে ক্লিনিক বা হাসপাতালগুলোতে যারা ভর্তি হয়েছিলেন, তাদের চিকিৎসায় যেন কোনও অবহেলা না হয়, তাদের চিকিৎসা যেন সঠিকভাবে হয় সে বিষয়ে নির্দেশ দেন।’
অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান আরও বলেন, ‘আহত নেতা-কর্মীদের অধিকাংশই ছিলেন পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাই তারা আহত হওয়াতে পরিবারগুলো যেন আর্থিক অসুবিধায় না পরে সেটা দেখার জন্যও নির্দেশ দেন আমাকে। তবে প্রাথমিকভাবে আমাদের ওপর নির্দেশনা ছিল, ঢাকা শহরের ক্লিনিক-হাসপাতালগুলোয় ভর্তি হওয়া আহতদের চিকিৎসা বিষয়ে খেয়াল রাখার। নেত্রী বলেছিলেন, “আমাকে নিয়ে তোমরা চিন্তা করো না, যারা আহত আছেন তাদের তোমরা আগে দেখো।’”