দেশহীন মানুষের কথা


উখিয়ার বালুখালী এলাকায় রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী বসতি। ছবি: বাংলা ট্রিবিউনবাংলাদেশের জমিতে সবুজ চাদরের মতো বিছিয়ে থাকা দিগন্তজোড়া ধানের ক্ষেত গিয়ে মিলেছে মিয়ানমারের সবুজেমোড়া পাহাড়ের পাদদেশে। যে পাহাড়ের মাথায় মেঘেরা আছড়ে পড়ে। ওদিকে সর্পিল নাফ সীমান্ত উপেক্ষা করে নূতন যৌবনের দূতের মতো ছুটে চলেছে সমুদ্রের সঙ্গে মিলতে। চোখজুড়ানো দৃশ্য। যেন ছবি। কিন্তু ওই মেঘ কি জানে, তারই ছায়াতলে মানুষ মরছে? পাহাড় কি জানে, তার পদতলে ঘর পুড়ছে? ধানক্ষেত কি জানে, কত মানুষ নিজের দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে? নাফ কি জানে, কত স্বপ্ন অশ্রু হয়ে গড়িয়ে পড়ছে?

টেকনাফের শাহপরীরের দ্বীপের পশ্চিমপাড় দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকতে গিয়ে পাড়ের কাছে ট্রলার ডুবির ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনায় নিহত একজনরে মরদহে। ছবি: বাংলা ট্রিবিউন

রোহিঙ্গা পরিস্থিতি যতটা খারাপ ভেবেছিলাম কক্সবাজারে এসে দেখি অবস্থা তার চেয়ে অনেক অনেক গুণ বেশি খারাপ। পিঁপড়ের মতো মানুষ আসছে মিয়ানমার থেকে। কোথায় যাবে, কোথায় থাকবে, কি করবে- এসব চিন্তা না করে কেবল প্রাণটা বাঁচাতে মানুষগুলো ছুটে আসছে এখানে। অনেকে দিনের পর দিন হেঁটে চলে আসছে বাংলাদেশে। এই অনিশ্চত পথ চলার যেন শেষ নেই। বড়দের সঙ্গে তাল মেলাতে পারে না শিশুরা। পড়ে যায়, আবার উঠে দাঁড়ায়। ছোট ছোট প্রাণগুলো, কারো মাথায় বস্তা, কারো পিঠে ছোট্ট ভাই বা বোনটি, কারো কাঁধে রাজ্যের তল্পিতল্পা। যারা হাঁটতে পারে না তাদেরকে কোলে-পিঠে-কাঁধে করে নিয়ে আসছে সবলরা। তারা এসে সড়কের ধারে পড়ে থাকছে, রোদে পুড়ছে, বৃষ্টিতে ভিজছে।টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের পশ্চিমপাড় দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে রোহিঙ্গারা। টেকনাফের দিকে যাচ্ছেন এক রোহিঙ্গা বৃদ্ধা। হারিয়াখালী এলাকা থেকে তোলা ছবি।ছবি: বাংলা ট্রিবিউন

 যাদের ভাগ্য ভালো তারা উঠেছে উখিয়া উপজেলার বালুখালি কিংবা কুতুপালংয়ের আশ্রয় শিবিরে। সবার ভাগ্য ভালো নয়, বিশেষ তাদের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় যাদের সঙ্গে পুরুষ নেই! পুরুষ থাকলেই বা কি! ক্যাম্পে জায়গা না থাকলে সড়কের ধারেই তো আশ্রয় নিতে হবে। হাজার হাজার মানুষ খোলা আকাশের নিচে দিনরাত কাটাচ্ছে। ওই খোলা আকাশও সদয় নয়। কিছুক্ষণ পর পর বৃষ্টি। ভিজছে ছোটবড় সবাই, যা বৃষ্টিবিলাস তো নয়। যখন বৃষ্টি নেই তখন প্রখর রৌদ্র। রোদে ঝলসে যাওয়ার মতো অবস্থা। রোদের মধ্যেই ত্রাণ সামগ্রীর জন্য বালুখালী এলাকায় দীর্ঘ মানবসারি। সারিতে থাকা অনেকের অবস্থাই দেখলাম করুণ। দিনে সড়কের ধারে, গভীর রাতে দোকান ও বহুতল ভবনের ছাউনির নিচে গিয়ে আশ্রয় নেয় মানুষগুলো। রাতে মশার উপদ্রব, সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। উদ্বাস্তু হওয়ার যন্ত্রণা যাদের বুকে তাদের বুঝি এসব তুচ্ছ উপদ্রব আমলে নিতে নেই।টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের পশ্চিমপাড় দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে রোহিঙ্গারা। টেকনাফের দিকে যাচ্ছেন এক রোহিঙ্গা বৃদ্ধা। হারিয়াখালী এলাকা থেকে তোলা ছবি।ছবি: বাংলা ট্রিবিউন

শিশুগুলোর মুখের দিকে তো তাকানোই যায় না। শিশুদের অবস্থা দেখে যেকোনও বিবেকবান মানুষের অপরাধবোধ হবে। শিশুগুলোর চোখে চোখ রাখা যায় না। ক্ষুধার কষ্ট, ক্লান্তি ও ভয় যেন জমাট বেঁধে আছে ওই ছোট ছোট চোখে। অচেনা মানুষ দেখলেই ভয় পায়। প্রশ্ন করলে জবাব দেয় না। তাদের বাবা-মায়েরাও পাথরের মতো হয়ে গেছে বুঝি। 

বালুখালী ক্যাম্পে পেটের ব্যথায় মাটিতে লুটিয়ে কাঁদছে ৫-৬ বছরের সন্তান। কাঁদাজলে বসে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন মা। উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে পেলাম অসহায় এক বাবাকে। ছোট্ট মেয়েটি বমি করেই যাচ্ছে সেদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তিনি। কি করবেন! কিইবা করতে পারেন! মেয়েটি কত আদরেরই না ছিল! কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি আদর-সোহাগ, মায়া-মমতাকে নির্মমভাবে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। অবশিষ্ট শুধু, টিকে থাকার চেষ্টাটুকু।ত্রাণ সামগ্রীর পাওয়ার আশা রোহিঙ্গা নারীরা। বালুখালী এলাকা থেকে তোলা ছবি। ছবি: বাংলা ট্রিবিউন

কিছুদিন আগেও তাদের এমন জীবন ছিল না। তাদেরও দেশ ছিল, সবুজ পাহাড়ঘেরা ছবির মতো দেশ। তাদেরও ভিটে ছিল। সেই ভিটের উঠানে মুরগি ছিল, গোয়াল ঘরে গরু ছিল। পরিবার ছিল, প্রতিবেশী ছিল। আর ছিল স্বপ্ন। নির্ঘুম চোখে এখন স্বপ্ন নেই। সেই বসতি এখন জ্বলছে। সেদিন সন্ধ্যায় টেকনাফের নাইট্যং পাড়া এলাকায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম গ্রাম পুড়ছে। নীলাভ সন্ধ্যার রোমান্টিকতা ম্লান হয়ে যাচ্ছে ধোঁয়ার ধূসরতায়।ক্ষিধের যন্ত্রণায় কাঁদছে তসলিমা। ছবিটি উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্প থেকে তোলা। ছবি: বাংলা ট্রিবিউন

প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে মরছে মানুষ। শাহপরীর দ্বীপের পশ্চিম দিকের সমুদ্রসৈকতে পড়ে আছে আনোয়ারা বেগমের নিথর দেহ। পাশে বসে বুক চাপড়াছেন আনোয়ারার শ্বশুর। ইঞ্জিনচালিত ট্রালারে করে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসেছিলেন তারা। নতুন জীবনের কাছাকাছি এসে ডুবে যায় ট্রলার। নতুন জীবনে পা রাখা হলো না আনোয়ারার। এভাবেই জীবনের সন্ধানে এসে মৃত্যুকে পেয়েছে অনেক রোহিঙ্গা। আর যারা বাংলাদেশে পা রাখতে পেলো তাদের অনেককেই এই পলিমাটিতে চুমু খেতে দেখেছি। বিলাপ করে কেঁদেছে অনেকে।

লেখক: ফটোসাংবাদিক ও লেখক।