বৃহস্পতিবার (২৩ নভেম্বর) বিকাল সাড়ে ৪টায় রজধানীর শুক্রাবাদে বাংলা ট্রিবিউন স্টুডিওতে অনুষ্ঠিত ‘গুম’ শীর্ষক বৈঠকিতে বক্তারা এসব কথা বলেন।
তিনি আরও বলেন, ‘হঠাৎ করেই দেশে গুমের একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছে, গুমের আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। কিন্তু কী এমন ঘটলো যে গুমের প্রয়োজন পড়লো। আবার গুমের কারণ বলতে পারার পেছনেও একটাও গুমের ভয় থেকে যায়। গুম হয়ে অনেকে ফিরে এসেছেন। তারা কেউ কেউ কথাও বলেছেন। যেমন, জোহাকে তুলে নেওয়া হয়েছিল। তিনি অনেক পরে কথা বলেছেন, আর যা বলেছেন তা খুবই শর্টকাট।’
তিনি বলেন, ‘গুমের ঘটনাগুলোর তদন্তের একটা পর্যায়ে দেখা যায়, তদন্তের আর কোনও অগ্রগতি হয় না। একটা পর্যায়ে গিয়ে পুলিশ আর কিছু বলতে চায় না। দায়সারা কথা বলে। বলে তদন্ত চলছে। কিন্তু ওই তদন্তের আর কোনও কূল-কিনারা আলোর মুখ দেখে না। তারা সরাসরি বলে, তারা কিছু জানে না। কিন্ত গুম বিষয়টিতে তলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, বিষয়টি একটি রাজনৈতিক সমস্যা। পুলিশ পারে না— তা কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না।’
জায়েদুল আহসান পিন্টু আরও বলেন, ‘রাষ্ট্রের দর্শন যদি থাকে, রাজনৈতিক ইচ্ছে থাকে, তাহলে একজন মানুষও আর নিখোঁজ হবে না। কিন্তু রাষ্ট্র সেই অবস্থানটি নিচ্ছে না। এই জায়গা থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায়, রাজনৈতিকভাবে দ্বিমত পোষণকারীরাই গুম হয়। এখন যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, গুমেরও একসময় সামাজিক বৈধতা তৈরি হবে। সমাজ এসব ঘটনাকেও সহজেই গ্রহণ করে নেবে।’
গুম হওয়ার ঘটনায় প্রশাসন বা পুলিশের দায় নিয়ে সাবেক আইজি বলেন, ‘পুলিশ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হয়ে কাজ করে, সেটাই তাদের করার কথা। কিন্তু তারা প্রজাতন্ত্রের হয়ে কাজ করছে নাকি অন্য কারও হয়ে কাজ করছে, তা খতিয়ে দেখতে হবে। এ নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গির তফাৎ থাকতে পারে। গুম হওয়াদের মধ্যে তিনটি দল তৈরি হয়েছে— কেউ ফিরছে, কেউ ফিরছে না, বাকিরা ফিরলেও কথা বলছে না। এখন ফিরে আসা কেউ কেউ কথা বলতে শুরু করেছেন। অনিরুদ্ধ নামের নিখোঁজ এক ব্যবসায়ী ফিরে আসার তিন দিনের মাথায় লিখিত বক্তব্য দিয়েছেন। এটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। কারণ, এর মাধ্যমে কথা বলে আলোচনার পথ দেখিয়েছেন তিনি। কিন্তু নীতিনির্ধারকরা এ বিষয়ে আলোচনা করবেন কিনা, সেটা তারাই ভালো বলতে পারবেন। একসময় তো প্রতিবাদ হতো না, এখন প্রতিবাদ হয়। তিনি ফিরে এসে কথা বলে প্রতিবাদেরও সুযোগ করে দিয়েছেন।’
বৈঠকিতে সাবেক আইজি আরও বলেন, ‘ভয়ের আবহাওয়া থেকে রেহাই পেতে প্রতিবাদ করতে হবে। তা না করতে পারলে আমাদের যতটুকু সাহস ছিল, তাও হারিয়ে যাবে। এসব নিয়ে সংসদেও আলোচনা হচ্ছে না। নীতিনির্ধারকরা এই পরিস্থিতি থেকে রেহাই দিতে এগিয়ে না এলে তারাও কিন্তু তাদের অনুসারীদের কাছ থেকে নিজেদের চাওয়া অনুযায়ী আচরণ পাবেন না। ফলে গুম হয়ে যাওয়ার এই পরিবেশ দূর করতে না পারলে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘‘গুম শব্দটি ব্যবহার করলে এই অপরাধের ভয়াবহতা স্পষ্ট হয় না। কিন্তু ইংরেজিতে এর অর্থ স্পষ্ট। ইংরেজিতে শব্দটি ‘ফোর্সড ডিজঅ্যাপেয়ারেন্স’। এর অর্থ এভাবে বোঝানো হয়েছে- জোরপূর্বক বা বলপূর্বক একজন ব্যক্তিকে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে তুলে নিয়ে নিখোঁজ করে দেওয়া। এর ভয়াবহতার মাত্রা এ কারণে বেশি যে এর শিকার ব্যক্তিকে আইনের স্পর্শ থেকে দূরে রাখা হয়। তিনি চাইলেই তার নিজের বিচার চাইতে পারেন না। তিনি সম্পূর্ণ অসহায় হয়ে পড়েন।’
মিজানুর রহমান আরও বলেন, ‘আমরা এতকিছু জানার পরও এই ধরনের অপরাধ দেশে কেন হচ্ছে? এসব অপরাধ তখনই ঘটে, যখন সমাজ ও রাষ্ট্রে আইনের শাসন অনেক দুর্বল হয়ে পড়ে। যখন স্বচ্ছতার মাত্রা অনেক কম হয়, তখন অতি উৎসাহীরা সুযোগ পেয়ে যায়। চেইন অব কমান্ড না থাকলে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের অনেকেও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেন। আর এসব কারণেই সমাজে গুমের মতো একটি ভয়াবহ পরিস্থিতি ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্য দিয়ে ভয়ের সংস্কৃতিও তৈরি হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সবাই জানি, গুম নিয়ে পত্রিকায় যতটুকু খবর আসে, পরিস্থিতি তার চেয়ে অনেক বেশি ভয়াবহ। এখানে আমরা আজ আলোচনা করছি। তবে কেউ কিন্তু কোনও গ্রুপের নাম বলতে পারিনি। এখানেও একটি সেন্সরশিপ কাজ করছে।’
এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক আরও বলেন, ‘যারা ফিরে এসেছে, তাদের আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেছি। একবার যেহেতু গুম হয়েছে, আবারও গুম হওয়ার আশঙ্কা কাজ করে তাদের মধ্যে। এ কারণেই গুম হওয়া ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরা এ নিয়ে কথা বলে না। এই যে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, এই সংস্কৃতি থাকলে প্রতিবাদ করবেন কিভাবে? প্রশ্ন থেকে যায়, সমাজে ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করার জন্যই এগুলো করা হচ্ছে কিনা।’
রাজধানীর শুক্রাবাদে বাংলা ট্রিবিউন স্টুডিও থেকে বৈঠকিটি সরাসরি সম্প্রচার করে এটিএন নিউজ। পাশাপাশি বাংলা ট্রিবিউনের ফেসবুক পেজ ও ওয়েবসাইটেও লাইভ দেখানো হয় বৈঠকি।
আরও পড়ুন-
‘গুম’ শীর্ষক বাংলা ট্রিবিউন বৈঠকি শুরু
‘রাজনৈতিকভাবে দ্বিমত পোষণকারী লোকই গুম হয়
যারা গুম করে তারা খুবই প্রশিক্ষিত: হারুন উর রশীদ
‘গুমের প্রতিবাদকারীরাও ভয়ে থাকেন, কখন গুম হয়ে যান’
‘রাষ্ট্র উদাসীনতা দেখালে গুমের নৃশংসতা আরও ভয়াবহ রূপ নেয়’
বিচারহীনতার কারণেই গুমকারীরা পার পেয়ে যাচ্ছে: সাবেক আইজিপি
গুম থেকে রেহাই দেওয়ার দায়িত্ব যার, সেই রাষ্ট্রই নিরব: ফিরোজ আহমেদ