ভাঙাচোরা ভবনে সরকারি চিকিৎসালয়

dispensaryকোনও চিকিৎসক নেই। রোগী দেখছেন মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট। রোগীর প্রচুর চাপ। একের পর এক রোগী আসছেন। নিজের রোগের কথা বলছেন। স্লিপ লিখে দিলে পাশের রুম থেকে ঔষধ নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন। তবে চিকিৎসালয়টির ছাদের দিকে তাকালে আঁতকে উঠতে হয়। ছাদের প্রায় তিনভাগই স্যাঁতস্যাঁতে অবস্থায় রয়েছে। ছাদের পলেস্তারা খসে পড়ছে। দেয়ালের চুনকাম খুলে পড়ছে। এমন ঝুঁকিপূর্ণ ছাদের নিচে দেওয়া হচ্ছে চিকিৎসা  সেবা। ৩১ ডিসেম্বর রবিবার সকাল সাড়ে দশটার দিকে সরেজমিনে এমন চিত্র দেখা গেলো রাজধানীর জনসন রোড বহির্বিভাগ চিকিৎসালয়ে।

রাজধানীর পুরান ঢাকার জনসন রোডের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের পিছনে নিচতলার অংশে জনসন রোড বহির্বিভাগ সরকারি চিকিৎসালয়। হঠাৎ করে কেউ গেলে তার জন্য খুঁজে পাওয়া বেশ মুশকিল। তবে অগত্যা যাদের স্বাস্থ্য সেবার প্রধান অবলম্বন এই চিকিৎসালয় তাদের এটি এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।

জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের পেছনে ছোট্ট লোহার গেট দিয়ে ঢুকলে পাওয়া যাবে এই চিকিৎসালয়। সামনের অংশে কিছু ফাঁকা জায় থাকায় ডানে বামে স্তূপ করে রাখা আছে ইট সিমেন্টের বস্তা।

প্রবেশমুখেই সামনে সামান্য ফাঁকা জায়গা থাকায় সেখানে দুটি মোটরসাইকেল রেখে গেছেন দুই জন আরোহী। দুই কদম এগুতেই হাতের বামে ছোট্ট টিনের ঘর। টিকিট লেখা থাকলেও এতে তালা দেওয়া। ঘরটি পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই ছোট্ট বারান্দার ডানে ও বামে হার্ডবোর্ড দিয়ে তিনটি রুম বানিয়ে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। চারটি টিউবলাইট আর দুইটি ফ্যান দিয়ে পুরো ফ্লোরটি কাভার করা হয়েছে। তিন রুমের একটিতে লেখা ডাক্তার-১, ডাক্তার-২। ডাক্তার-২ রুমে বসে রেজিস্ট্রারে রোগীর নাম ও বয়স লিখে রোগের বর্ণনা শুনে ছোট্ট কাগজে রোগীর জন্য মেডিসিন লিখে দিচ্ছেন সাব এসিস্ট্যান্ট মেডিক্যাল অফিসার হালিমা আক্তার লুপা। তার কাছ থেকে রোগীরা মেডিসিনের স্লিপ নিয়ে ছোট্ট বারান্দায় লাইনে দাঁড়ান। সেখানে এমএলএসএস নুরুন্নাহারের কাছ থেকে ঔষধ সংগ্রহ করেন তারা।

হালিমা আক্তার লুপা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অনেক আগের বিল্ডিং। এই জন্য এই অবস্থা। কিছুদিন আগে রিপেয়ার করেছে। চুনকাম করার পর থেকে এখন বিল্ডিংয়ের অবস্থা বেশ ভালো। আরও ভালো করার জন্য লোকজন এসে দেখে গেছে। ছবি তুলে নিয়ে গেছে। খুব তাড়াতাড়ি রিপেয়ার হবে।’

dispensary 02

গ্যাস্ট্রিকের ঔষধ নিতে আসা ইমদাদুল (৩৫) বলেন, ‘মাত্র কয়দিন আগে বড় সাহেবেরা আইস্যা ছবি তুইল্যা নিয়ে গ্যাছে। বেশিদিন লাগবো না। বিল্ডিং ঠিক হয়্যা যাইব।’

ডাক্তার দেখিয়ে ঔষধ নিতে এসেছেন দিনমজুর মিজান (৮০)। কাজের ফাঁকে এসেছেন ঔষধ নিতে। তখনও গায়ের পোশাকে ময়লা লেগে আছে। বললেন, ‘আমার শ্বাসকষ্ট হয়। পেট ফেঁপে যায়। এখানেই দেখাচ্ছি।’

সাদা ছড়ি হাতে ঔষধ নিতে এসেছেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শহীদ (৫৮)। ব্যথা ও জ্বরের ঔষধ নিলেন তিনি। বুড়িগঙ্গা নদী পেরিয়ে এক বছর দুই মাস বয়সী ছেলে সোহানকে নিয়ে এসেছেন মা শিপু। ছেলের ঠাণ্ডা জ্বর। তাই ঔষধ নেবেন। শিপু বলেন, এক বছর আগে এখান থেকে ঔষধ নিয়ে রোগ ভালো হয়েছে। তারপর থেকে এখান থেকেই সবসময় ঔষধ নেই।

এই চিকিৎসালয়টি খোলা থাকে সকাল আটটা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত। তবে দুপুর ১২টায় ঔষধ দেয়া বন্ধ হয়ে যায়। ঠাণ্ডা, জ্বর, ডায়রিয়া, চুলকানি ও গ্যাস্ট্রিকের সমস্যার রোগী এখানে বেশি। প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা ও ঔষধ সম্পূর্ণ ফ্রি। রোগীদের মূলত গ্যাস্ট্রিক, ব্যথা, জ্বর, ঠাণ্ডা, এলার্জির ঔষধ এখান থেকে দেওয়া হয়। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা হওয়ায় এখানে চর্মরোগের রোগী অনেক বেশি।

লুপা বলেন, রোগীদের চাহিদা থাকলেও বরাদ্দ না থাকায় অনেক ঔষধ দেওয়া সম্ভব হয় না। বিশেষ করে বয়স্ক শ্বাসকষ্টের রোগীদের জন্য শ্বাসকষ্টের ঔষধ আছে। তার সঙ্গে নেবুলাইজারটা দিতে পারলে খুবই ভালো হতো।

ভবনটি প্রসঙ্গে ঢাকার সিভিল সার্জন ডা. মো. এহসানুল করিম বলেন, ‘যে কয়টি সরকারি ডিসপেনসারি আছে, সেগুলোর মধ্যে হাজারীবাগ ও জনসন রোডেরটার অবস্থা বেশি খারাপ। আমরা এগুলো ঠিক করার চেষ্টা করছি। দ্রুত এগুলোর ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

দেড় ঘন্টা ধরে এই প্রতিবেদক চিকিৎসালয়টিতে উপস্থিত ছিলেন। সে সময়ে অসুস্থতাজনিত ছুটি ও ভিআইপি কলের কারণে চারজন চিকিৎসক একসঙ্গে অনুপস্থিত ছিলেন। একসঙ্গে সবাই অনুপস্থিত থাকার ব্যাপারে সিভিল সার্জন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘একসঙ্গে চারজন ডাক্তার তো অনুপস্থিত থাকার কথা না। ভিআইপি ডিউটিতে আমরা কখনও কখনও ডাক্তারদের পাঠাই। তবে একসঙ্গে তো চারজন ডাক্তারকে পাঠাই না। কেন কোনও ডাক্তার উপস্থিত ছিলেন না, বিষয়টি আমরা অবশ্যই খতিয়ে দেখবো।’