সাধারণত ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মন্ত্রীর যাবতীয় কাজের হিসেব রাখেন। জানতে চাইলে যুগ্ম সচিব পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, মন্ত্রীর পিএর কাজ বিভিন্ন ফাইল, অভিযোগ, আবেদন রিসিভ করা। সিন (দেখানো) করানো। সিন করানোর পর ফাইল ডাউন করা (মন্ত্রীর কাছ থেকে সচিব দফতরে পাঠানো)। মন্ত্রীকে টেলিফোনে সংযোগ করিয়ে দেওয়া। এছাড়া, মিটিং ও অন্যান্য কাজে আপ্যায়ন করা মূল কাজ।
২০১২ সালের ৯ এপ্রিল বিজিবির সদর দফতরের মূল ফটকে বিপুল অংকের টাকাসহ তৎকালীন রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তর সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) ওমর ফারুক তালুকদার, রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলীয় মহাব্যবস্থাপক (জিএম) ইউসুফ আলী মৃধা ও রেলের নিরাপত্তা বাহিনীর কমাড্যান্ট এনামুল হক আটক হন। তারা দাবি করেন, ওই টাকা নিয়ে তারা রেলমন্ত্রীর বাড়িতে যাচ্ছিলেন। পরে বেরিয়ে আসতে থাকে দুর্নীতির নানা ঘটনা। ঘটনার আট দিন পর দুর্নীতির কেলেংকারিতে কোণঠাসা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তার পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন।
এর তিন বছর পর ২০১৫ সালে তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (পিও) মো. সহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে হুন্ডি ব্যবসাসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। তবে সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয় মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে ২০১৫ সালের ৩০ এপ্রিল অনুষ্ঠিত নবম বৈঠকে ক্ষোভ প্রকাশ করে তথ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। কমিটির বৈঠকে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দেওয়া হয়েছিল।
এর দুই বছর পর গতকাল রবিবার সকাল সাড়ে ৮টায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের রিসিভ ও ডেসপাচ শাখার উচ্চমান সহকারী মো. নাসিরুদ্দিনকে এক লাখ ত্রিশ হাজার টাকাসহ গুলশান এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তার সঙ্গে যোগাযোগের সূত্র ধরে মোতালেব হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সরাসরি কিছু না বলে সোমবার (২২ জানুয়ারি) সকালে সাংবাদিকদের বলেন, ‘(কেউ) কোনও অন্যায়, দুর্নীতি বা ঘুষের মধ্যে জড়াবে না (চাকরিবিধিতে) এরকম তো বলা আছেই। কিন্তু তারা এ ধরনের কাজে জড়িত, এমন রিপোর্ট কেউ আমাদের দেয় নাই।’
এদিকে অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, শিক্ষামন্ত্রীর পিও মোতালেব হোসেন পশ্চিম ধানমন্ডির বি ব্লকের ৪নং রোডের ২৬ নম্বর প্লটে নির্মাণাধীন বাড়িটির মালিক। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নির্মাণাধীন বাড়িটি এখন যে অবস্থায় আছে জমিসহ সেটির বর্তমান বাজার মূল্য অন্তত সাড়ে চার কোটি টাকা। যদিও তার মূল বেতন ২৮ হাজার ১০০ টাকা। বাড়ি ভাড়াসহ বিভিন্ন খাতে কেটে নেওয়ার পর বর্তমানে মাসে মোট ১৩ হাজার ৮৮ টাকা উত্তোলন করেন তিনি। তার ব্যাংক লোন আছে ৬ লাখ টাকা। এ কারণে তার এমন কোটি টাকার ভবন নির্মাণ বিস্ময়কর বলে মন্তব্য করেছেন অনেকেই।
এর আগে গত ২৪ ডিসেম্বর শিক্ষা ভবনে ‘সহনীয় মাত্রায় ঘুষ খাওয়ার’ পরামর্শ দিয়ে বক্তব্য রেখে তোপের মুখে পড়েন শিক্ষামন্ত্রী। টিআইবি বিবৃতি দিয়ে এর ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরলেও সংবাদ সম্মেলন করে প্রকাশিত সংবাদ ভুল বলে দাবি করেন মন্ত্রী। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ডিআইএর (পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতর) এক অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, ‘দায়িত্ব নেওয়ার পর সব সংস্থার সঙ্গে আমি বসেছি। তখন বলেছি, দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। সব জায়গায় এ কথা বললেও ইইডির (শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর) সভায় বলেছি, আপনারা ভালো কাজ করবেন। আপনারা ঘুষ খাবেন, কিন্তু সহনশীল হয়ে খাবেন। কেননা, আমার সাহসই নাই বলার যে, আপনারা ঘুষ খায়েন না।’ ওই সময় নুরুল ইসলাম নাহিদ নিজেকে ও সব মন্ত্রীকেও চোর বলে আখ্যায়িত করেন।
ওইসময় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বিবৃতি দিয়ে বলেছিলেন, প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী মন্ত্রিপরিষদের সব সহকর্মীসহ নিজেকে চোর সম্বোধন করে জনমনে সরকার সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর ধারণার অবতারণা করেছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাগুলোসহ সব উন্নয়নমূলক ভবিষ্যত রূপরেখায় সব ধরনের ঘুষ লেনদেন ও দুর্নীতি নির্মূলের ব্যাপারে সরকার সম্পূর্ণরূপে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং ইতোমধ্যেই লক্ষ্যপূরণে ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। এমন সময়ে জাতির ভবিষ্যত বিনির্মাণে নিবেদিত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতো সংবেদনশীল একটি মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এ ধরনের বক্তব্য কোনও অবস্থায় গ্রহণযোগ্য নয়।’
রবিবার শিক্ষামন্ত্রীর পিও’র দুর্নীতি এবং তার ভিত্তিতে গ্রেফতারের ঘটনার পর ড. ইফতেখারুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যেহেতু তিনি (পিও) সরকারি কর্মকর্তা, সেহেতু তার সম্পদের বিষয়ে ভালো করে তদন্ত করতে হবে।’ তিনি মনে করেন মন্ত্রণালয়কেই এ বিষয়ে কাজ করতে হবে। তাছাড়া, একজন দুর্নীতিবাজ কখনওই এককভাবে দুর্নীতি করতে পারে না উল্লেখ করে এই পর্যবেক্ষক বলেন, ‘এই কর্মকর্তার সঙ্গে আরও অনেকেই জড়িত থাকতে পারে।’
গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী মনে করেন যারা মন্ত্রীর সঙ্গে ঘোরাফেরা করেন তাদের জনগণ দেখে। মন্ত্রীর পিও ছয়তলা বাড়ি বানাচ্ছেন, সেক্ষেত্রে নানা অনুমোদন নিশ্চয় নিতে হয়েছে। ঋণ নেওয়া, রাজউকের অনুমোদন– এগুলোর ক্ষেত্রে দফতরের অনুমোদনের ব্যাপারও হয়তো থাকে।
তিনি বলেন, ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতির খবরটা বের হয়েছে, কিন্তু বিভিন্ন সেক্টরে দুর্নীতি আছে, সেটা তো টিআইবির রিপোর্টেই বারবার বেরিয়ে আসছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় তার ব্যতিক্রম নয়। এটা সার্বিক চিত্রের কিছুটা অংশ। মন্ত্রীদের হয়তো এত কিছু জানার সুযোগ নেই। আমি মনে করি, এসব ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের মনিটরিংটা জোরদার করা উচিত।’