ভুয়া প্রশ্নের জমজমাট ব্যবসা





ফেসবুকে ভুয়া প্রশ্নএসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় এপর্যন্ত ১০টি বিষয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। এসব প্রশ্ন পরীক্ষা শুরুর আগেই পাওয়া গেছে হোয়াটসঅ্যাপসহ  সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।  এসব আসল প্রশ্নের ভিড়ে ভুয়া প্রশ্নের ছড়াছড়িও কম নয়। টাকার বিনিময়ে ভুয়া প্রশ্নের জমজমাট ব্যবসা করে যাচ্ছে একটি চক্র।


এবছর পরীক্ষা শুরুর আগ থেকেই ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে টাকার বিনিময়ে প্রশ্নপত্র সরবরাহের বিজ্ঞপ্তি লক্ষ্য করা গেছে। এই বিজ্ঞপ্তির সঙ্গে একাধিক বিষয়ের ভুয়া প্রশ্নপত্রের ছবি প্রকাশ করে  পরীক্ষার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়।
চক্রটি ২০১৭ সালের প্রশ্নপত্রের ওপরে ২০১৮ সাল লিখে ক্রেতাদের কাছে ‘রিয়েল প্রশ্নপত্র’ বলে দাবি করে। কোনও কোনও প্রশ্নপত্র থেকে সাল লেখার জায়গাটি ফেলে দিয়ে তা প্রকাশ করা হয়। অনেক সময় প্রশ্নের মূল অংশকে ঝাপসা করে দিয়ে তার ওপর লেখা হয়— ‘শতভাগ রিয়েল প্রশ্ন। ক্লিয়ার প্রশ্ন নিতে হলে যোগাযোগ করুন।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, একটি চক্র পরীক্ষা শুরুর আগের দিন ভুয়া প্রশ্ন ঝাপসা করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে পরীক্ষার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই প্রচারণা সারাদিনই চলতে থাকে। পরীক্ষার আগের দিন রাতে অন্য একটি ভুয়া প্রশ্নপত্রের আরেকটু পরিষ্কার ছবি ফেসবুকে প্রকাশ করা হয়। এরপর পরীক্ষা শুরুর দিন সকাল পাঁচটা থেকে সাড়ে আটটা পর্যন্ত অন্য একটি প্রশ্নপত্রের সম্পূর্ণ কপি প্রকাশ করা হয়, যা দেখতে হুবহু আসল প্রশ্নপত্রের মতো, অথচ সেটিও আসল প্রশ্নপত্র নয়। এই প্রশ্নপত্রের ওপরে সালের জায়গায় এডিট করে ২০১৮ লেখা হয়। অথবা কোনও টেস্ট পেপারে উদাহরণ হিসেবে থাকা প্রশ্নের ছবি তুলে সেটাও ‘রিয়েল প্রশ্ন’ উল্লেখ করে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। এরপর সকাল সাড়ে আটটা থেকে শুরু হয় ‘রিয়েল প্রশ্নে’র ( মূলত এটাই ফাঁস হওয়া এবারের আসল প্রশ্নপত্র) ছড়াছড়ি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুয়া প্রশ্নবৃহস্পতিবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) অনুষ্ঠিত বিজ্ঞান বিভাগের রসায়ন বিষয়ের পরীক্ষা শুরুর অন্তত তিন ঘণ্টা আগে সকাল ৬টা ৫৮মিনিটে রচনামূলক প্রশ্নপত্র হোয়াট্সঅ্যাপে পাওয়া যায়। তবে পরীক্ষা শেষে ওই প্রশ্নের সঙ্গে কেন্দ্রের প্রশ্নের কোনও মিল পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, পদার্থবিজ্ঞানসহ অনুষ্ঠিত সব পরীক্ষার আগে পাওয়া ভুয়া প্রশ্নের সঙ্গে পরীক্ষা কেন্দ্রে বিতরণ করা প্রশ্নের কোনও মিল পাওয়া যায়নি। 
বিগত সময়ে অনুষ্ঠিত সব পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অনুসন্ধান করতে গিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব ভুয়া প্রশ্নের দেখা মিলেছে। এছাড়া, প্রকৃত প্রশ্নপত্র মনে করে যারা ভুয়া প্রশ্নপত্র কিনে টাকা গচ্ছা দিয়েছেন, তারাও ওইসব গ্রুপে বিভিন্ন সময় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
সুদীপ্ত রায় নামের একটি ফেসবুক আইডি থেকে একটি গ্রুপে দেওয়া পোস্টে লেখা হয়েছে, ‘এই পেজ পুরা ভুয়া... কোনো প্রশ্ন তারা দেয় না... না বুঝে কেউ এ পেজের কাউকে টাকা দেবেন না... তারা প্রশ্ন দিতে পারবে না... যাদের কাছে প্রশ্ন থাকে, তারা কখনই এভাবে প্রচার করে না...আর প্রশ্ন কখনই এত তাড়াতাড়ি ফাঁস হয় না... তাই সবাই সাবধান।’

অন্যদিকে, হোয়াট্সঅ্যাপের বিভিন্ন গ্রুপেও অনেকেই দাবি করেন, ‘‘গ্রুপে গ্রুপে ভুয়া প্রশ্ন দেওয়া হয়। ‘রিয়েল প্রশ্ন’ কেউ দেয় না।’’ জানা গেছে, গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা ছদ্মবেশে ওইসব গ্রুপের কার্যক্রম নজরদারি করছেন।
ভুয়া প্রশ্নপত্রের বিজ্ঞাপনএদিকে শিক্ষাবিদ, অভিভাবক ও পরীক্ষার্থীদের দাবি, দ্রুত এই প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে হবে। এর জন্য প্রশ্নপত্র প্রণয়ন পদ্ধতির পরিবর্তন আনতে হবে।
তবে অনুষ্ঠেয় পরীক্ষাগুলোর প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাত্রা কমাতে প্রচুর পরিমাণ ভুয়া প্রশ্ন ছড়িয়ে দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন আইটি বিশেষজ্ঞরা। ন্যাসেনিয়া’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক শায়ের আহমেদ বলেন, ‘আমরা হয়তো প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে প্রশ্নফাঁস রোধ করতে পারবো। কিন্তু চলমান পরীক্ষায় আরও কিছু পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতে বাকি রয়েছে। এর মানে কি সবগুলো পরীক্ষাতেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হবে। এক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক একটি ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। যাতে করে প্রশ্নফাঁসের প্রভাব কিছুটা কমানো যায়, যেমন— সরকার নিজ উদ্যোগে  মন্ত্রণালয়ের কয়েকজনকে নিয়ে একটি দল গঠন করবে, যারা হোয়াট্সঅ্যাপসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আইডি খুলে প্রচুর পরিমাণ ভুয়া প্রশ্ন ছড়িয়ে দেবে। রিয়েল প্রশ্নের মাঝে ভুয়া প্রশ্ন ছেড়ে দিলে পরীক্ষার্থীরা দ্বিধায় পড়ে যাবে। তখন এর মাত্রা কমে আসবে।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তপন কুমার সরকার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আইডিয়াটি খারাপ না, কারণ— কোনও বড় ক্ষতির প্রভাব কমাতে এর চেয়ে ভালো উপায় আর হয় না। ভুয়া প্রশ্ন ছড়িয়ে পরীক্ষার্থীদেরকে বিভ্রান্ত করে দিলে,তারা রিয়েল প্রশ্ন পেয়েও ভয়ে থাকবে।’
বৃহস্পতিবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে সাংবাদিকদের এক অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় শিক্ষা সচিব সোহরাব হোসাইনও স্বীকার করেছেন, বিদ্যমান পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকানো সম্ভব নয়। তিনি বলেন,  ‘পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন নিয়ে ভাবছে সরকার।’
১ ফেব্রুয়ারি বাংলা প্রথমপত্রের বহুনির্বাচনি অভীক্ষার ‘খ’সেট পরীক্ষার প্রশ্ন ও ফেসবুকে ফাঁস হওয়া প্রশ্নের হুবহু মিল ছিল। পরীক্ষা শুরুর একঘণ্টা আগেই তা ফেসবুকে পাওয়া যায়।
৩ ফেব্রুয়ারি সকালে পরীক্ষা শুরুর প্রায় ঘণ্টাখানেক আগে বাংলা দ্বিতীয় পত্রের নৈর্ব্যক্তিক (বহুনির্বাচনি) অভীক্ষার ‘খ’ সেটের উত্তরসহ প্রশ্নপত্র পাওয়া যায় ফেসবুকে। যার সঙ্গে অনুষ্ঠিত হওয়া প্রশ্নপত্রের হুবহু মিল পাওয়া যায়।
ভুয়া প্রশ্ন৫ ফেব্রুয়ারি পরীক্ষা শুরুর অন্তত দুই ঘণ্টা আগে সকাল ৮টা ৪মিনিটে ইংরেজি প্রথমপত্রের ‘ক’ সেটের প্রশ্ন ফাঁস হয়। এর সঙ্গে অনুষ্ঠিত হওয়া প্রশ্নপত্রের হুবহু মিল পাওয়া গেছে।
৭ ফেব্রুয়ারি বুধবার পরীক্ষা শুরুর অন্তত ৪৮ মিনিট আগে সকাল ৯টা ১২ মিনিটে ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের ‘খ’ সেটের গাঁদা প্রশ্নপত্রটি হোয়াটসঅ্যাপের একটি গ্রুপে পাওয়া গেছে। যা অনুষ্ঠিত হওয়া প্রশ্নপত্রের সঙ্গে হুবহু মিলে গেছে।
৮ ফেব্রুয়ারি হোয়াটসঅ্যাপের একটি গ্রুপে ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষার বহুনির্বাচনি অভীক্ষার ‘খ’ সেটের চাঁপা প্রশ্নপত্রটি পাওয়া যায়। এটিও অনুষ্ঠিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের সঙ্গে হুবহু মিলে গেছে।
গত ১০ ফেব্রুয়ারি সকাল ৮টা ৫৯ মিনিটে হোয়াটসঅ্যাপের একটি গ্রুপে গণিতের ‘খ-চাঁপা’ সেটের প্রশ্নপত্রটি পাওয়া যায়, যা অনুষ্ঠিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের সঙ্গে হুবহু মিলে গেছে।
গত ১১ ফেব্রুয়ারি আইসিটি বিষয়ের প্রশ্নপত্র সকাল ৮টা ৫১ মিনিটে হোয়াটসআপের একটি গ্রুপে আইসিটির ‘ক’ সেট প্রশ্ন পাওয়া যায়। আর সকাল ৯টা ৩ মিনিটে ‘গ’ সেটের প্রশ্নও ফাঁস হয়।
গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ‘পদার্থ বিজ্ঞান’ এবং ‘ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং’ বিষয়ের প্রশ্নপত্রও হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে পাওয়া যায়, ওইদিনের পরীক্ষা শুরু আগেই।