ডব্লিউএইচও’র তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ৩৬ কোটি মানুষ শ্রবণ প্রতিবন্ধী, যা মোট জনসংখ্যার ৫ দশমিক ৩ ভাগ। এদের মধ্যে ৩২ কোটি ৮০ লাখ বা ৯১ ভাগ প্রাপ্তবয়স্ক। এর মধ্যে পুরুষ ১৮ কোটি ৩০ লাখ এবং নারী ১৪ কোটি ৫০ লাখ। ৩ কোটি ২ লাখ শিশু শ্রবণ প্রতিবন্ধী। শিশু শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের হার দক্ষিণ এশিয়া, এশিয়া প্যাসিফিক ও আফ্রিকায় বেশি। এই একই অঞ্চলে ৬৫ বছরের বেশি মানুষের এক-তৃতীয়াংশ শ্রবণ প্রতিবন্ধী।
বাংলাদেশ সরকারের মোটরযান বা যান্ত্রিক নৌযানজনিত শব্দের অনুমোদিত মানমাত্রা হচ্ছে মোটরযানের ক্ষেত্রে ৮৫ ডেসিবল (নির্গমন নল থেকে ৭ দশমিক ৫ মিটার দূরত্বে) এবং ১০০ ডেসিবল (নির্গমন নল থেকে শূন্য দশমিক ৫ মিটার দূরত্বে ৪৫ ডিগ্রি কৌণিক রেখায় পরিমাপ)।
দেশের নীরব এলাকাগুলোতে দিনে শব্দের অনুমোদিত মাত্রা হচ্ছে (সকাল ৬টা থেকে রাত ৯টা) ৫০ ডেসিবল এবং রাতে (রাত ৯টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত ৪০ ডেসিবল। আবাসিক এলাকায় দিনে ৫৫ ডেসিবল ও রাতে ৪৫ ডেসিবল, মিশ্র এলাকায় দিনে ৬০ ডেসিবল ও রাতে ৫০ ডেসিবল, বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ৭০ ডেসিবল ও রাতে ৬০ ডেসিবল, শিল্প এলাকায় দিনে ৭৫ ও রাতে ৭০ ডেসিবল থাকবে।
পরিবেশ অধিদফতর পরিচালিত এক জরিপে দেশের কোথাও কোথাও সর্বনিম্ন ৪০ ডেসিবল এবং সর্বোচ্চ ১৩০ ডেসিবল পর্যন্ত শব্দের মাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। স্থানগুলি সড়ক সংলগ্ন হওয়ায় যানবাহনের হর্ন উচ্চমাত্রার শব্দের অন্যতম উৎস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। দিনে ১২০ ডেসিবলের আকস্মিক শব্দ ১০ হাজার বার একজন মানুষের জন্য সহনীয়। সেখানে কোনও কোনও স্থানে ১০ মিনিটে নয়শ’ বারের বেশি হর্ন বাজে। এসব স্থানে থাকা মানুষ মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের নাক-কান ও গলা সার্জারি বিভাগের প্রধান ও অধ্যাপক ডা. মনিলাল আইচ লিটু বলেন, ‘বাংলাদেশের শব্দদূষণ পরিস্থিতি এখন মারাত্মক অবস্থায় রয়েছে। বর্তমানে ৭ থেকে ৯ ভাগ মানুষ বিভিন্ন মাত্রায় শ্রবণ প্রতিবন্ধী। যদি এ অবস্থা চলতে থাকলে ২০৩০ সালে এই মাত্রা হবে পাঁচ গুণ, যা আমাদের জন্য মারাত্মক হবে। শ্রবণ প্রতিবন্ধী হওয়ার পেছনে শব্দদূষণ একটা ফ্যাক্টর।’
তিনি বলেন, ‘মানুষকে সচেতন করতে হবে। কান খোঁচালে কান ফুটো হয়ে যায়। পাখির পালক, কটন বার দিয়ে কান খোঁচানোর হার বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় বেশি। অবহেলার কারণে কানে না শোনার যে সমস্যা, এটা থেকে দূরে থাকার জন্য সবাইকে দূরে থাকতে হবে।’
অধ্যাপক ডা. মনিলাল আইচ লিটু বলেন, ‘কানের যত্নকে প্রাইমারি হেলথ কেয়ারের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।’ শব্দদূষণ কমানোয় গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, ‘শব্দদূষণের যে মাত্রা তা স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। হাসপাতাল, স্কুল— এসব স্থানের আশেপাশে শব্দদূষণের মাত্রা আরও কম থাকতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত হাইড্রোলিক হর্ন নিষিদ্ধ হয়নি। যেখানে ড্রিলিং করে বা পাইলিং করে নির্মাণ কাজ হয়, তার আশপাশে চট দিয়ে শব্দ নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশের বেশিরভাগ জায়গায় এটা করা হয় না।’
ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট-এর উপ প্রকল্প ব্যবস্থাপক নাজনীন কবির বলেন, ‘এ সংক্রান্ত আইন হওয়ার পর শব্দদূষণ কিছুটা কমেছিল। কিন্তু এখন গাড়ি অনেক বেড়েছে, সবখানে শব্দ বাড়ছে। বিয়ে বাড়িতে অতিরিক্ত শব্দের কারণে একজনের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।’
তিনি বলেন, ‘মানুষ আগের চেয়ে অনেক সচেতন হয়েছে। এখন রাস্তাঘাটে কেউ হর্ন বাজালে অন্যরা প্রতিবাদ করেন। যেহেতু সচেতনতা বাড়ছে, এটা আস্তে আস্তে কমে আসবে। পরিবেশ অধিদফতরের ট্রেনিং ম্যানুয়াল আছে। সবদিক থেকে সচেতন হলে, সরকার উদ্যোগ নিলে, মানুষ সচেতন হলে, ড্রাইভাররা সচেতন হলে, গণমাধ্যম তার কাজ করলে শব্দদূষণটা কমে আসবে বলে মনে করি।’
পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক ফরিদ আহমেদ বলেন, ‘আইন বাস্তবায়নের জন্য পরিবেশ অধিদফতরের মাঠ অফিসগুলো কাজ করছে। আমাদের বিধিমালা ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনের আওতাভুক্ত এখনও হয়নি। ওই আইনের আওতাভুক্ত হলে আরও কিছু মোবাইল কোর্ট হতো। তবে পুলিশ, বিআরটিএ মোবাইল কোর্ট করছে। হাইড্রোলিক হর্ন পুলিশ এখন খুলে নিচ্ছে। হাইকোর্টেরও এই সংক্রান্ত নির্দেশনা রয়েছে।’ তবে ঢাকা শহরে মোবাইল কোর্ট করাটা কঠিন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ফরিদ আহমেদ বলেন, ‘শব্দদূষণের ক্ষেত্রে স্টেক হোল্ডার অনেক। সাধারণ মানুষের মটিভেশন দরকার। আমাদের সংস্কৃতিই হচ্ছে হর্ন বাজাতে হবে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে জোরে মাইক বাজাই। আমাদের বিধিমালাতে আছে, মাইক বাজিয়ে কোনও প্রোগ্রাম করতে চাইলে পুলিশের অনুমতি নিতে হবে। এগুলো মানুষ জানে না। এই অবস্থা পরিবর্তনে আমরা সচেতনতার বিষয়ে জোর দিচ্ছি।’
আইন বিশ্লেষক সৈয়দ মাহবুবুল আলম বলেন, ‘ঢাকা শহরে শব্দদূষণের বড় কারণ গাড়ির হর্ন। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য যে বিধিমালা আছে তার বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এটা বাস্তবায়ন করা জরুরি।’