সাগর বোমা তৈরির কারিগর, নিলয় অর্থের জোগানদাতা

 

 

হাসীদুর রহমন সাগর ও আকরাম হোসেন নিলয়বগুড়ার জেলা পুলিশ নব্য জেএমবির যে শীর্ষ দুই নেতাকে বুধবার (২১ মার্চ) রাতে গ্রেফতার করেছে তাদের একজন হাদীসুর রহমান সাগর নব্য জেএমবির বোমা তৈরির কারিগর। গুলশান হামলায় অস্ত্র ও বিস্ফোরক জোগানও দিয়েছিল সে। আর আকরাম হোসেন নিলয় নব্য জেএমবির সর্বশেষ আমির। নব্য জেএমবির অর্থের জোগানদাতা হিসেবেও কাজ করতো নিলয়। গুলশান হামলার পর কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম-সিটিটিসি ইউনিটের বিভিন্ন অভিযানে শীর্ষ নেতাদের মৃত্যু হলে নিলয়কে সংগঠনের মূল সমন্বয়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

সিটিটিসির একাধিক কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

বৃহস্পতিবার (২২ মার্চ) সাগরকে গুলশান হামলা মামলায় এবং নিলয়কে পান্থপথের হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালে বিস্ফোরণের ঘটনায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে তোলা হয়। আদালত সাগরকে সাত দিন এবং নিলয়কে ছয় দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন।

ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের উপ-কমিশনার মহিবুল ইসলাম খান বলেন, ‘সাগর নব্য জেএমবির গুরুত্বপূর্ণ এবং সিনিয়র নেতা ছিল। গুলশান হামলায় গ্রেফতার হওয়া বিভিন্ন জনের স্বীকারোক্তিতে সাগর অস্ত্র ও বিস্ফোরক সরবরাহ করেছিল বলে জানা গেছে। আর তামিম চৌধুরী এবং মুসা মারা যাওয়ার পর নিলয় আমির হিসেবে নব্য জেএমবিকে সংগঠিত করার চেষ্টা করছিল। সে সংগঠনের জন্য অর্থের জোগানদাতা হিসেবেও কাজ করেছে।’

মহিবুল ইসলাম বলেন, ‘সাগর ও নিলয়কে দুটি মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ডে আনা হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। জিজ্ঞাসাবাদে তাদের আর কোন কোন ঘটনার সঙ্গে যোগসূত্র রয়েছে এবং তাদের কী পরিকল্পনা ছিল বা তাদের সহযোগীদের সম্পর্কে জানার চেষ্টা করা হবে।’

কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট সূত্র জানায়, হাদীসুর রহমান সাগর পুরনো জেএমবির সদস্য। ২০০১ সালে জয়পুরহাট সদরের বানিয়াপাড়া আলিয়া কামিল মাদ্রাসা থেকে আলিম পাস করে সে। এরপর জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে। তার বাড়িও জয়পুরহাটের কয়রাপাড়ায়। বাবার নাম হারুন অর রশিদ। জঙ্গিবাদে জড়িয়ে আর বেশি লেখাপড়া করেনি সাগর। পুরনো জেএমবির শীর্ষ নেতা ডা. নজরুলের সঙ্গে তার বেশি সখ্য ছিল। নজরুলই তাকে নব্য জেএমবির আরেক শীর্ষ নেতা মারজানের বোনের সঙ্গে বিয়ের ব্যবস্থা করে দেয়। মারজানের খালু সোহেল মাহফুজ ওরফে হাতটাকা মাহফুজও ছিল পুরনো জেএমবির শীর্ষ নেতা। কয়েক বছর আগে নিজের দলের সদস্যদের হাতে ডা. নজরুল মারা যায়। আর সোহেল মাহফুজসহ অন্যদের নিয়ে নব্য জেএমবিতে যোগ দেয়।

সিটিটিসি সূত্র জানায়, নব্য জেএমবির সাংগঠনিক কাজকর্ম শুরুর সময় যে সাতজন শূরা সদস্য হিসেবে মনোনীত হয়েছিল তার মধ্যে সাগরের নামও ছিল। প্রথমদিকে সে সামরিক কমান্ডার হিসেবে কাজ করেছে। বোমা তৈরিতেও ছিল দক্ষ। এমনকি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারত থেকে বিস্ফোরক আনার রুটগুলো জানা ছিল তার। এ কারণে সাগরকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এলাকার দায়িত্বশীলও বানানো হয়।

কর্মকর্তারা বলছেন, সাগরকে অনেকদিন ধরেই খুঁজছিল কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশান হামলার পর গ্রেফতার হওয়া একাধিক আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জানায়, গুলশান হামলায় অস্ত্র ও বোমা সরবরাহের দায়িত্ব ছিল সাগরের ওপর। সাগর ছোট মিজানকে সঙ্গে নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ থেকে অস্ত্র ও বোমা নিয়ে ঢাকার শেওড়াপাড়ার বাসায় নিয়ে আসে। সেখান থেকে অস্ত্র ও বোমা নিয়ে যাওয়া হয় বসুন্ধরার বাসায়। সেসব অস্ত্র ও বোমা নিয়েই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালায় পাঁচ জঙ্গি।

এদিকে গ্রেফতার হওয়া আরেক আসামি আকরাম হোসেন নিলয় ইংলিশ মিডিয়ামে লেখাপড়া করা ছাত্র। ঢাকার ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল স্কলাস্টিকা এবং ব্রিটিশ কাউন্সিল থেকে ‘ও’ এবং ‘এ’ লেভেল শেষ করেছে সে। এরপর মালয়েশিয়ার লিংকন ইউনিভার্সিটিতে পড়তে গিয়েছিল। ২০১২-১৩ সালে গুলশানের আজাদ মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়ে প্রথমে সালাফি মতবাদে উদ্বুদ্ধ হয় নিলয়। পরে সে নব্য জেএমবির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে।

কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা বলছেন, নিলয়ের সঙ্গে নব্য জেএমবির অন্যতম প্রধান মাস্টারমাইন্ড বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক তামিম চৌধুরীর যোগাযোগ হয়। একপর্যায়ে তামিমের সে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। এছাড়া গুলশান হামলার ঘটনায় নিবরাস ইসলামসহ রোহান ইমতিয়াজ ও মীর সামিহ মোবাশ্বেরের সঙ্গেও তার পরিচয় ছিল। গুলশান হামলার দুই মাসের মাথায় সিটিটিসির অভিযানে তামিম চৌধুরী মারা গেলে মাইনুদ্দিন মুসা নব্য জেএমবির সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। পরবর্তীতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের এক অভিযানে মুসা নিহত হলে মূল সমন্বয়কের দায়িত্ব নেয় নিলয়। সংগঠনের সবাই তাকে আবু আব্দুল্লাহ হিসেবে চিনতো। এছাড়া ‘স্লেড উইলসন’ ও ‘জ্যাক স্প্যারো’ নামে আরও দুটি সাংগঠনিক নামও ছিল তার।

কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা বলেন, নিলয় ছিল খুবই দুর্ধর্ষ প্রকৃতির। দায়িত্ব নেওয়ার পর ১৫ আগস্টে বোমা হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ও অর্থের জোগানদাতা ছিল সে। বড় একটি হামলার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল সে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে অন্য কোন কোন ঘটনার সঙ্গে সে জড়িত, তা জানার চেষ্টা চলছে।

ওই কর্মকর্তা জানান, গত বছরের ১১ নভেম্বর গুলশান এলাকা থেকে নিলয়ের বাবা আবু তোরাব, মা সাদিয়া হোসনা লাকি এবং বোন তাজরীন খানম শুভ্রকে গ্রেফতার করা হয়। নিলয়ের পরিবারের সব সদস্যই জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। নিলয় আত্মগোপন করে ভারতে যাওয়ার পর তার পরিবারের সদস্যরা নিয়মিত ভারতে গিয়ে তাকে টাকা-পয়সা দিয়ে আসতো।