সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সড়ক দুর্ঘটনা এদেশে অনেকটা মহামারীর মতো। তবে গত তিন মাসের পর্যালোচনা বলছে, দুর্ঘটনার ব্যাপকতা বেড়েছে। বর্তমানে পরপর কয়েকটি ঘটনায় এটি অনেক বেশি নজরে এসেছে। মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, বিচারের মুখোমুখি করতে না পারার কারণে এবং ক্ষমতাবানদের ছত্রচ্ছায়ায় চালকরা পার পেয়ে যাওয়ায় কমছে না সড়ক দুর্ঘটনা।
আগের বছর ২০১৭ সালে চার হাজার ৯৭৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন সাত হাজার ৩৯৭ জন। ২০১৬ সালে চার হাজার ৩১২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ছয় হাজার ৫৫ জন নিহত ও ১৫ হাজার ৯১৪ জন আহত হয়েছিলেন। বিগত বছরের তুলনায় ২০১৭ সালে দুর্ঘটনা বেড়েছে ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ। নিহত ২২ দশমিক ২ শতাংশ এবং আহত ১ দশমিক ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গত কয়েকমাসে সড়ক দুর্ঘটনার হার বেড়েছে। হাইওয়ে ও শহরের মধ্যে দুর্ঘটনার ধরণ-কারণ ভিন্ন। শহরের দুর্ঘটনার বিষয়ে প্রথমেই বলতে হবে গণপরিবহনের কর্মীদের দায়িত্বহীনতার কথা। গণপরিবহনের যে মান থাকার কথা, তা নেই। যখন গণপরিবহন করপোরেট কালচার নিয়ে এগোবে, চালক ও বাস মানসম্পন্ন হবে, বাস চলাচলের জন্য স্পেশাল লেন থাকবে, তখন এ ধরনের দুর্ঘটনা হয় না। অথচ আমাদের এখানে প্রশিক্ষণ নেই, মুনাফা বাড়ানোর জন্য চুক্তিভিত্তিক গাড়ি চালায়, ১৬ ঘণ্টা টানা বাস চালাচ্ছে, বেতন কাঠামোর ঠিক নেই। এরকম একটি বড় সিটিতে এ ধরনের পরিবহন ব্যবস্থা চালানো হলে দুর্ঘটনা ঠেকানো যাবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকার মতো আয়তনের দ্বিতীয় কোনও সিটি খুঁজে পাবেন না, যেখানে ৫০ কোম্পানি মুনাফার দিকে নজর দিয়ে পরিবহন চালাচ্ছে। পরিকল্পিত বাস অপারেশনের অনুপস্থিতির কারণেই ঢাকায় এই দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে।’
সড়কে সমস্ত অব্যবস্থাপনা ও বিশৃঙ্খলা জিইয়ে রেখে নৈরাজ্যকর পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছে উল্লেখ করে বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নগরীর প্রতিটি বাস-মিনিবাসের ব্যবসা মূলত চালকরা নিয়ন্ত্রণ করছেন। দৈনিক চুক্তিভিক্তিক ইজারায় মালিকরা তাদের বাস চালকের হাতে তুলে দেন। এ কারণেই চালকরা যাত্রী ধরার জন্য সড়কে ভয়ঙ্কর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। গণপরিবহন পরিচালনায় এ ধরনের ব্যবস্থা আর কোনও দেশে নেই। এই অরাজকতা বন্ধ করা না গেলে নগরে দুর্ঘটনা কমানো যাবে না।’
আইনের প্রয়োগ নেই উল্লেখ করে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়রম্যান কাজী রিয়াজুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘একের পর এক ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরও যখন আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয় না, তখন মানুষ শৃঙ্খলা হারায়। প্রতিটি দুর্ঘটনায় নিহতের ঘটনায় যদি যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হতো, তাহলে কিছুটা সতর্কতা অবশ্যই আসতো। সেটি না হওয়াতেই আমাদের সড়কে অব্যবস্থাপনা ও নৈরাজ্যের চাকায় রোজ মানবাধিকার পিষ্ট হচ্ছে।’
শনিবার বাসচাপায় পা হারানো রোজিনা খাতুন সিনিয়র সাংবাদিক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজার বাসার গৃহকর্মী। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুকে হত্যাকাণ্ড উল্লেখ করে ইশতিয়াক রেজা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রোজ রক্তাক্ত হচ্ছে রাজপথ। কারণ এখানে কোনও শৃঙ্খলা নেই, কেবল নৈরাজ্য। পরিবহন মালিকদের কেউ না কেউ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তারা সব দলে আছে, তারা প্রভাবশালী। তারা কোনও আইন করতে দেয় না। রাজনৈতিক প্রশ্রয়ের কারণে শৃঙ্খলায় আসা সম্ভব হচ্ছে না। কিছু হলে ধর্মঘট করে এরা সারাদেশ অচল করে দেয়। ফলে এখানে কোনও কিছু করা সম্ভব হচ্ছে না। স্বার্থের কাছে এসে সব দল এক হয়ে যাচ্ছে।’