‘আমাদের যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি দেওয়া হোক’

80c4ad68755a400cf1442876107f53cd-59ddd9e807738

হিজড়াদের নিয়ে সমাজের কেউ ভাবে না বলে আক্ষেপ করেছেন হিজড়া জবা রানী (৩০)। শুধু কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হিজড়াদের নিয়ে কাজ করে দাবি করে তিনি বলেন, ‘সরকার তো কিছুই করে না। শুধু স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু চাকরিতে কোনও কোটা নাই। নারী ও পুরুষ সবার জন্য চাকরিতে আলাদা কোটা আছে, আমাদের নাই। তাহলে কিসের স্বীকৃতি। আমাদেরকে যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি দেওয়া হোক। নিয়োগে আমাদের কথা উল্লেখ থাকে না কেন? আলাদা লিঙ্গ হলে আলাদাভাবে পদক্ষেপ নেয় না কেন? নিয়োগে আমাদের ডাকা হোক, যোগ্যতা থাকলে চাকরি করবো, না থাকলে করবো না।’  

বাংলা ট্রিবিউনকে এক সাক্ষাতকারে এসব কথা বলেছেন জবা হিজড়া। বেশ গুছিয়ে সুন্দর করে কথা বলতে পারেন জবা। রাজধানীর ভাটারা এলাকায় তার সঙ্গে এক ঘণ্টার অধিক সময় কথা হয়। গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ায়, থাকেন ঢাকায়। বাবা-মায়ের চার সন্তানের মধ্যে জবা রানী মেজো।

শরীরের পুরুষ কাঠামো নিয়ে মেয়েলি আচরণের কারণে শৈশবে একাধিকবার যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন দাবি করে তিনি বলেন, ‘উপায় না পেয়ে এখন যৌনকর্মকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছি।’

তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাজধানীর বিমানবন্দর রেললাইন এলাকায় প্রায় ৮ বছর ধরে ভাসমান যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করছেন তিনি। পরিবার ও সমাজচ্যুত হওয়ার পর তিনি আলাদা এক সমাজে মিশে গেছেন, সে সমাজ শুধুই তাদের।

নিজের অতীত প্রসঙ্গে জবা বলেন, ‘একজন চিকিৎসকের বাসায় থেকে কুষ্টিয়ার একটি মিশনারি স্কুলে লেখাপড়া করেছি। পাশাপাশি তাদের বাসার কাজও করে দিতাম। কিন্তু এসএসসি পাসের পর আর সেখানে তারা রাখেনি। এরপর আমি ঢাকার মানিকগঞ্জে চলে আসি। কিছুদিন পোশাক কারখানায় ছেলে পরিচয়ে কাজ করি। কিন্তু সেখানেও আমার মেয়েলি আচরণের জন্য অনেক কথা শুনতে হতো। তারপর চলে আসি চাকরি ছেড়ে। হিজড়া জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আমার আগেই টুকটাক পরিচয় ছিল। এরপর থেকে তাদের সঙ্গে থাকা শুরু করলাম।’

এ ব্যাপারে জবা আরও বলেন, ‘হিজড়াদের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর দেখলাম, এখানে কেউ কাজ করে না। ভিক্ষা করে ও যৌনকর্মই তাদের পেশা। এরপর আমিও শুরু করলাম।’ তার দেখা বেশিরভাগ হিজড়াই যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করেন বলেও তিনি জানান।

জবার দাবি, নিজেকে পরিপূর্ণ নারী হিসেবে দেখতে শরীরেও পরিবর্তন এনেছেন জবা। ভারতে গিয়ে সিলিকনের স্তন প্রতিস্থাপন করেছেন তিনি। 

যৌনকর্মকে পেশা হিসেবে নেওয়ার কারণ হিসেবে জবা বলেন, ‘আমি স্কুলে পড়া অবস্থায় আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড় পুরুষের দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হয়েছি। আমাকে ধর্ষণ করা হয়েছে। তখন অনেক খারাপ লেগেছিল। বড় হওয়ার পরও যেখানেই কাজে যেতাম, সেখানেই আমার গায়ে হাত দেওয়া হতো। মেয়েলি আচরণ করি দেখে সবাই অপ্রয়োজনে গায়ে হাত দিতো।’  

জানা যায়, বিমানবন্দর রেলস্টেশন এলাকায় প্রায় অর্ধশত নারী ও হিজড়া যৌনকর্মীদের সঙ্গে তিনিও প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে রাত ১০ টা পর্যন্ত থাকেন। এ ব্যাপারে জবা বলেন, ‘সব শ্রেণির খদ্দের আসে সেখানে। প্রতিদিন সাতশ’ থেকে আটশ’ টাকা আয় হয়।’ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ওই এলাকাতে অভিযান চালালে সেদিন তাদের কাজ বন্ধ থাকে বলেও জানান তিনি।

জবা আরও বলেন ‘ঢাকায় প্রতিমাসে থাকা-খাওয়া বাবদ প্রায় ১০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়। এই টাকা আয় করে টিকে থাকা প্রতিদিনই চ্যালেঞ্জ।’

হিজড়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে এইচআইভি আক্রান্ত রোগী থাকার বিষয়েও তথ্য আছে জবার কাছে। এজন্য একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্রতিমাসে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন বলেও জানিয়েছেন তিনি।

জবা বলেন, ‘ওই প্রতিষ্ঠানটি স্বাস্থ্য পরীক্ষার পাশাপাশি যৌনকর্মীদের কনডমও বিতরণ করে থাকে। তারা স্বাস্থ্যের বিষয়ে গুরুত্ব দেয়। আমরাও তাদের সহযোগিতা করি।’

ক্ষোভ প্রকাশ করে জবা বলেন, ‘ধীরে ধীরে বয়স বাড়ছে, কতদিন আর যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করতে পারবো। একদিন এভাবে আয়ও করতে পারবো না, সেদিন আমাকে কে দেখবে? বাবা-মা বেঁচে থাকলেও তাদের বয়স হয়েছে। বাড়িতেও যেতে পারছি না। ভবিষ্যতে যেতে পারবো, তারও কোনও নিশ্চয়তা নেই। তাই বয়স হওয়ার আগেই মরে যাবো। এভাবে আর বাঁচা যায় না।’

 

আরও খবর:
যোগ্যতা থাকার পরও হিজড়া হওয়ায় সরকারি চাকরি পাননি জোনাক

ঘরছাড়া ববি এখন হিজড়াদের ঘরের ব্যবস্থা করেন

হিজড়াদের ‘তৃতীয় লিঙ্গ’র স্বীকৃতি আছে, অধিকার নেই