দেশের শীর্ষস্থানীয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলা ট্রিবিউনের আয়োজনে বৃহস্পতিবার (১৭ মে) বিকাল সাড়ে ৪টায় বাংলা ট্রিবিউন কার্যালয়ে আয়োজিত বৈঠকিতে এসব কথা বলেন আলোচকেরা। এ আয়োজন সরাসরি সম্প্রচার করে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন নিউজ। পাশাপাশি বাংলা ট্রিবিউনের ফেসবুক ও হোমপেজে লাইভ দেখা যায় বাংলা ট্রিবিউন বৈঠকি।
মাহমুদুল হকের সঞ্চালনায় বৈঠকিতে অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন ও অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ও নির্বাচন পর্যবেক্ষক কাজী মারুফুল ইসলাম, ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের পরিচালক আবদুল আলীম, ইন্ডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের প্রধান বার্তা সম্পাদক আশিষ সৈকত, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, বিএনপি’র সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ এবং বাংলা ট্রিবিউনের হেড অব নিউজ হারুন উর রশীদ।
আগামী মাসের গাজীপুরের নির্বাচন বিষয়ে তিনি বলেন,‘স্থানীয় সরকার নির্বাচন ও জাতীয় নির্বাচনের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। অথচ স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে এমনভাবে জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে আলোচনায় জড়ানো হচ্ছে এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে স্থানীয়রা। কারণ, জাতীয় নেতারা যখন স্থানীয় নেতাদের ওপর এতটাই নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন, তখন ওই স্থানীয় নেতারা তাদের স্থানীয় সাধারণ মানুষের জন্য দেওয়া প্রতিশ্রুতি কতখানি রাখতে পারবেন, তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। ফলে ওই স্থানীয় নির্বাচনকে ওই গণ্ডির মধ্যেই রাখার দায় রয়েছে সব রাজনৈতিক দলের।
কাজী মারুফুল ইসলাম বলেন, ‘গাজীপুর নির্বাচনের জন্য খুলনা নির্বাচন থেকেই শিক্ষা নেওয়ার আছে, নির্বাচন কমিশনের যে ভূমিকা তা এর নির্দিষ্ট মাপকাঠির চেয়ে অনেক নিচে ছিল। ফলে নির্বাচন কমিশনের কিছু শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে হবে। পুলিশ প্রশাসনকে নিরপেক্ষ থেকে কাজ করতে হবে। নির্বাচনের প্রার্থীদের নির্বাচনি প্রচারণা অর্থাৎ সাংবিধানিক অধিকারটি নির্বাচন কমিশনকেই সুষ্ঠুভাবে ভোগ করার ব্যবস্থা করে দিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘এই যে প্রচারণা তা ছিল শান্তিপূর্ণ। কারণ,কোনও বড় ধরনের ভায়োলেশন হয়নি,বড় ধরনের কোনও মারামারি হয়নি,কেউ মারা যায়নি। ফলে নির্বাচন সে অর্থে সুষ্ঠুভাবেই হয়েছে।’
আসন্ন গাজীপুর সিটি নির্বাচন বিষয়ে আবদুল আলীম বলেন, ‘যেহেতু কাল (শুক্রবার) থেকে রোজা শুরু হচ্ছে, এদিকে সামনেই গাজীপুরে নির্বাচন। সেক্ষেত্রে নির্বাচনের প্রচারণা হিসেবে গরিবদের দান করা যাবে কিনা, জাকাত দেওয়া যাবে কিনা, ইফতার পার্টির আয়োজন করা যাবে কিনা, এখনই এসব বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে ঠিক করে দিতে হবে। কারণ, সময় হাতে নেই। সব কথার শেষ কথা, ইলেকশন জাতীয় হোক আর স্থানীয় হোক, কমিশনকে আরও শক্ত ভূমিকায় আসতে হবে। এবং অন্য দলগুলোর উচিত কমিশনকে সহযোগিতা করা।’
ইন্ডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের প্রধান বার্তা সম্পাদক আশিষ সৈকত বলেন, “সদ্য সমাপ্ত খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগমুহূর্তে একটি ভীতিকর পরিস্থিত সৃষ্টি হয়েছিল। জনমনে একরকম আতঙ্ক কাজ করেছে। তবে ভোটগ্রহণের দিন দেখা গেলো সেখানে গ্রহণযোগ্য ভোট অনুষ্ঠিত হচ্ছে। উৎসবমুখর ছিল, এটা ঠিক; তারপরও বিছিন্ন কিছু ঘটনা ছিল,এটাও ঠিক। কিন্তু খুব বড় ধরনের কিছু হয়নি। তবে ভয়ভীতির একটি পরিস্থিতি ছিল। ফলে শতভাগ ‘লেভেল প্লেইং ফিল্ড’ ছিল তা বলা ঠিক হবে না, এটা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।”
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, ‘২ কোটি ভোটার লুকিয়ে নির্বাচন করতো বিএনপি, সেটার আমূল পরিবর্তন সুষ্ঠুভাবে করেছে আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশের নির্বাচনি সংস্কারগুলো যে আওয়ামী লীগ বাস্তবায়ন করেছে, তা হচ্ছে সচ্ছ ব্যালট বাক্সসহ সমস্ত নির্বাচন ব্যবস্থা।’
তিনি বলেন, ‘বিজয়ী তালুকদার খালেক জয়লাভের পরেই মঞ্জুকে সঙ্গে নিয়ে দেশের জন্য কাজ করতে যাওয়ার ঘোষণা দিলেন,অথচ সেই সন্ত্রাসী মঞ্জু তা প্রত্যাখান করে বললেন,ভোট ডাকাতের সঙ্গে তার কোনও কিছু হবে না। এর মানে কি বোঝায়? তিনি কি আদৌ কোনও মানুষের সম্মান রেখেছেন? বিএনপির যে অভিযোগ,তা কেবল দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে ফুলিয়ে-ফাপিয়ে প্রচার করা ছাড়া কিছুই নয়। আওয়ামী লীগ কিন্তু নির্বাচন থেকে সরে আসেনি,বিএনপি সরে গিয়েছে। ৩টি সিটিতে জয়ী হওয়ার পরও বিএনপি জাতীয় নির্বাচনে আসার সাহস পায়নি। কিন্তু এবার অন্তত খুলনা সিটি নির্বাচনে তারা অংশ নিয়েছে,এ জন্য তাদের ধন্যবাদ।’
বিএনপি’র সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ বলেন, ‘খুলনার ভোটব্যাংক ও গাজীপুরের ভোটব্যাংক সবই ঠিকঠাকই রয়েছে। এখানে ভোটারের সংখ্যাতেও সমস্যা নেই। আমি নির্বাচনের সময় খুলনা গিয়েছিলাম। নির্বাচনি প্রচারণার সময় দেখেছি, নৌকার জন্য ভোট চাওয়া হচ্ছে, কোনও সমস্যা নেই। বিএনপির মঞ্জুর পক্ষে ভোট চাইতে পারছেন না গ্রেফতারের ভয়ে। আমার পাশ থেকে একটি ছেলেকে ডিবি ধরে নিয়ে গেলো। জানতে চাইছিলাম তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ কী? কিন্তু তারা তা দেখাতে পারেনি। পরে ভোটগ্রহণের দিন দেখলাম, দুপুরের মধ্যে ব্যালট শেষ হয়ে গেছে। মিডিয়া দেখিয়েছে, কীভাবে নৌকায় সিল মারা হয়েছে। কয়েকটি কেন্দ্রে ৯০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে। এটা কি বাস্তব? যে তিনটি ভোটকেন্দ্র স্থগিত করা হয়েছে তার বাইরেও অনেক কেন্দ্রে ভোট জালিয়াতি হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে ঐক্য ছিল, এটা ঠিক। কিন্তু নির্বাচনে প্রচারণা তো বিএনপিকে করতে দেওয়া হয়নি। ভোটের দিনও ইলেকশন কমিশনারকে মির্জা ফখরুল ইসলাম কল দিয়ে বলেছিলেন, কেন আপনি আমাদের অভিযোগ আমলে নিচ্ছেন না? কিন্তু তিনি সেসব আমলে নেননি। আমরা নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগ দাবি করছি এসব কারণেই যে তারা আমাদের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আমলে নেয়নি।’
বাংলা ট্রিবিউনের হেড অব নিউজ হারুন উর রশীদ বলেন, ‘নির্বাচন ফেয়ার হলো কিনা, তা বুঝতে হলে এর প্রক্রিয়া শুরু থেকে ফল ঘোষণা পর্যন্ত টোটাল বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতেই হয়। প্রথমে প্রার্থীরা একে অপরের বিরুদ্ধে তাদের হলফনামায় তথ্য গোপনের অভিযোগ তুলেছিলেন, অথচ সেই অভিযোগের কিন্তু সেই অর্থে কোনও সুরাহা হয়নি। কিন্তু ইলেকশন কমিশনের আইন অনুযায়ী তদন্তে যদি অভিযোগুলো প্রমাণিত হয়, তাহলে তাদের প্রার্থিতা বাতিল হওয়ার কথা। ফলে প্রথমেই নির্বাচন কমিশন অস্বচ্ছ ও অনৈতিক কাজ করলো। এরপর আসি গ্রেফতারি বিষয়টি নিয়ে। প্রশ্নটা হলো, সারাদেশে ওয়ারেন্ট ও গ্রেফতার একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু বিশেষ পরিস্থিতিতে, বিশেষভাবে যখন নির্বাচনের সময় বিশেষ ব্যক্তিদের, যারা দলীয় লোকজন, তখন তাদের গ্রেফতার করা হয় এবং এগুলো চোখে পড়ে, তখন নির্বাচনকে কিছুটা হলেও ব্যাহত করে। এমন গ্রেফতারে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও গ্রেফতার করা হয়েছে।’
বিশিষ্ট এই সাংবাদিক আরও বলেন, ‘ওখানে বেশ কিছু সাংবাদিককে নির্বাচনের খবর কাভার করার জন্য কার্ড দেওয়া হয়েছে। এর বাইরেও কিছু ব্যক্তিকে কার্ড দিয়েছে, যারা সাংবাদিক না। যারা বিভিন্ন কেন্দ্রে একটি নির্দিষ্ট ভূমিকা পালন করেছে। এরা তাহলে কারা? যারা বিভিন্ন প্রার্থীর পক্ষে তারা ওয়ার্ক করেছে। এটা ওখানকার মেইনস্ট্রিম সাংবাদিকরা এর প্রতিবাদও করেছেন।‘
খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির ভূমিকা তুলে ধরে হারুন উর রশীদ আরও বলেন, ‘মঞ্জু সাহেব নির্বাচন নিয়ে অনেক আওয়াজ দিয়েছেন, মাঠে ছিলেন। তবে সে অর্থে বিএনপির অবস্থান একটু নড়বড়ে ছিল। তাদের কেন্দ্রীয় নেতাকর্মীদের খুব একটা মাঠে দেখা যায়নি। তবে এটা ঠিক যারা নির্বাচনে জয়লাভ করেছে তারা স্ট্রিমরোলারকে উপেক্ষা করেই জয়লাভ করেছে।’