কেন বন্ধ করা যাচ্ছে না মোবাইলের মাধ্যমে প্রতারণা

মোবাইল ব্যাংকিংকখনও বিকাশের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে ফোন করে অ্যাকাউন্ট সেটিং করার নামে, কখনও জিনের বাদশা সেজে কিংবা গাড়ি-বাড়ি দেওয়ার লোভ দেখিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে চলছে প্রতারণা। সহজ-সরল অনেকে না বুঝে প্রতারক চক্রের ফাঁদে পা দিয়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন। গত কয়েক বছর ধরে চলে আসা এ প্রতারণা বন্ধ করতে পারছে না পুলিশ। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠান বিকাশের মাধ্যমে এই প্রতারণা হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। পুলিশ বলছে, প্রতারক চক্রের বেশির ভাগ সদস্যই একই এলাকার বাসিন্দা।
ফরিদপুরের ভাঙ্গা ও মধুখালী থানার তিনটি গ্রামের বাসিন্দারা রীতিমতো প্রতারণাকেই পেশা বানিয়ে ফেলেছে। তাই এই তিন গ্রামের সব বিকাশ ব্যবহারকারীর অ্যাকাউন্ট স্থগিত করে নতুন করে রেজিস্ট্রেশন করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে।
ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সাইবার ক্রাইম বিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, মোবাইল ফোনে প্রতারণা বন্ধ না হওয়ার একমাত্র কারণ প্রতারকরা অন্যের নামে নিবন্ধন করা সিম ব্যবহার করছে। এমনকি প্রতারকরা যেসব মোবাইল নম্বর দিয়ে প্রতারণা করে, সেসব নম্বর দিয়ে শুধু ভিকটিমদের সঙ্গেই কথা বলে তারা। এ কারণে মোবাইলের কললিস্টের সূত্র ধরে প্রতারকদের শনাক্ত করতে অনেক বেগ পেতে হচ্ছে।
কর্মকর্তারা বলছেন, রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের থানাগুলোতে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ মোবাইল ফোনে অর্থ প্রতারণার শিকার হয়ে পুলিশি সহযোগিতার জন্য আসছেন।
সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগের তথ্যমতে, ২০১৭ সালে ঢাকার ৪৯ থানায় অভিযোগ দায়েরের বাইরে মোবাইলে অর্থ প্রতারণার ৫১টি অভিযোগ পেয়েছে সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগ। এছাড়া এ বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত ৬৭টি অভিযোগ পেয়েছে তারা।
সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, লাখ টাকার কম প্রতারণার শিকার হলে ভুক্তভোগীরা সাধারণত থানা পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনও ইউনিটের দ্বারস্থ হন না। বেশি পরিমাণ টাকা প্রতারণার শিকার হলেই কেবল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ছুটে আসেন।
সম্প্রতি রাজধানীর মুগদা এলাকার শওকত আলী নামে এক ব্যক্তি অভিযোগ করেন, হঠাৎ একদিন তার ব্যক্তিগত নম্বরে ফোন করে লটারির মাধ্যমে বসুন্ধরায় বাড়ি ও গাড়ি পাওয়ার কথা বলে তাকে। মিষ্টি-মধুর কথা বলে প্রতারক চক্রের সদস্যরা প্রথমে তার কাছ থেকে পাঁচটি বিকাশ নম্বরের মাধ্যমে ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা নেয়। পরে নতুন একটি বিকাশ নম্বরসহ ছয়টি নম্বরে দ্বিতীয় দফায় ১৭ লাখ ৮০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়। এছাড়া কৌশলে শওকত আলীর কাছ থেকে আরও ৮ ভরি স্বর্ণালঙ্কারও নিয়েছে প্রতারকরা। সব হারিয়ে নিঃস্ব শওকত আলী মুগদা থানায় একটি অভিযোগ (নং ১৪৮৫) করেন। বিষয়টি তদন্ত করতে গিয়ে সাইবার সিকিউিরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগের কর্মকর্তারা দেখতে পান, বিকাশ অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করা প্রতিটি মোবাইল নম্বরই অন্য লোকজনের নামে নিবন্ধিত করা সিম। ভুল তথ্য ও জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর ব্যবহার করে বিকাশ অ্যাকাউন্টগুলোও খোলা হয়েছিল।
সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগের সিনিয়র সহকারী কমিশনার আজহারুল ইসলাম মুকুল বলেন, ‘মোবাইল ব্যাংকিং প্রতারণা ঠেকাতে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে কার্যকর কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।’
মোবাইল ফিন্যান্স সিকিউরিটি বিভাগের দায়িত্বরত এই কর্মকর্তা জানান, কয়েকটি কারণে তারা প্রতারণা বন্ধ করতে পারছেন না। এগুলোর মধ্যে সাধারণত মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট খোলার সময় যাচাই-বাছাই করা হয় না। পরিচয় নিশ্চিত না হয়েই অ্যাকাউন্ট খোলা, অন্যজনের ছবি ও তথ্য ব্যবহার করা, টাকা তোলার ক্ষেত্রেও ভুল তথ্য ব্যবহার করা, মাঠ পর্যায়ে নীতিমালা না মানাসহ আরও কিছু কারণ রয়েছে। তারা প্রতারকদের গ্রেফতারের চেষ্টার পাশাপাশি কেউ যাতে প্রতারণার শিকার না হন সেসব বিষয় নিয়ে কাজ করছেন বলে জানান আজহারুল ইসলাম মুকুল।

প্রতারণার মূল হোতারা ফরিদপুরের তিন গ্রামের বাসিন্দা
মোবাইল ব্যাংকিং প্রতারণা প্রতিরোধে যুক্ত কর্মকর্তারা বলছেন, একসময় মাদারীপুরের লুন্দি গ্রামের বাসিন্দারা নানা রকম প্রতারণার সঙ্গে যুক্ত ছিল। সেখানকার লোকজন প্রতারণাকে ‘হ্যালো ব্যবসা’ বলে অভিহিত করতো। কিন্তু বর্তমানে ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার আজমীরনগর ও কালাইমৃধা গ্রাম এবং মধুখালী উপজেলার ডুমাইন গ্রামের বাসিন্দারা এই প্রতারণার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছে।
সম্প্রতি সাইবার সিকিউরিটি ও ক্রাইম বিভাগের কর্মকর্তারা এ তিন গ্রামের অবস্থানরত মোবাইল ব্যাংকিংয়ের জন্য নিবন্ধিত মোবাইল সিমগুলো থেকে লেনদেন স্থগিত করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি চিঠি পাঠিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগের মোবাইল ফিন্যান্স সিকিউরিটি টিম গত দুই বছর ধরে বিভিন্ন ব্যাংকিং, অনলাইন ব্যাংকিং ও মোবাইল ব্যাংকিং সেবা সংক্রান্ত অভিযোগ, জিডি ও মামলার তদন্ত করে আসছে। বর্তমানে প্রায় ২৬টি ব্যাংকিং ও দুইশ’র বেশি মোবাইল ব্যাংকিং সংক্রান্ত জালিয়াতি ও প্রতারণামূলক মামলা তদন্তাধীন। এসব মামলা ও অভিযোগ পর্যালোচনা করে প্রতারক চক্রের সদস্যরা ভুলবশত ক্যাশ ইন হয়েছে, লটারি জয়লাভের প্রলোভন দেখিয়ে, নিজেকে জিনের বাদশা পরিচয় দেওয়াসহ বিভিন্ন পথ অবলম্বন করে মানুষের টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিচ্ছে। প্রতারক দল বিভিন্ন কোম্পানির প্রি-অ্যাকটিভ এবং অন্যের নামে রেজিস্ট্রেশন করা সিম ব্যবহার করে প্রতারণা করে আসছে।
ওই চিঠিতে সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগ বলেছে, তদন্তে পাওয়া বেশিরভাগ অভিযুক্ত ব্যক্তির ট্র্যাকিং লোকেশন ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলার আজমীরনগর ও কালাইমৃধা গ্রাম এবং মধুখালী উপজেলার ডুমাইন গ্রাম। এরই মধ্যে এ তিন গ্রাম থেকে অন্তত ৪০ জন প্রতারককে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা আদালতে নিজেদের অপরাধ স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিও দিয়েছে।
সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগ বলছে, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রতারণা বন্ধের জন্য ফরিদপুরের তিন গ্রামে যেসব মোবাইল ব্যাংকিং সিম ব্যবহার করা হচ্ছে, সেগুলোর ডিস্ট্রিবিউটরদের জবাবদিহিতার মাধ্যমে অবৈধ মোবাইল ব্যাংকিংয়ে যুক্ত সিমের উৎস উদ্ঘাটন ও কঠোরভাবে বন্ধ করতে হবে। এছাড়া এসব এলাকার মোবাইল ব্যাংকিং ট্র্যানজাকশন (লেনদেন) স্থগিত করে সঠিক পরিচয়ের ভিত্তিতে পুনরায় ভেরিফিকেশনের মাধ্যমে লেনদেনের অনুমতি দিতে হবে। এজেন্ট ও ডিস্ট্রিবিউটরদের পুনরায় সঠিক তথ্য দেওয়ার মাধ্যমে পুনরায় লাইসেন্স করে লেনদেনের অনুমতি দিতে হবে।