বিয়ে ইস্যুতে উদ্বেগ ব্রিটেনের মুসলিম কমিউনিটিতে





বিয়ের প্রতীকী উপস্থাপনাবিবাহবিচ্ছেদ, নিবন্ধনবিহীন বিয়ে ও ফোর্স ম্যারেজ (জোরপূর্বক বিয়ে) নিয়ে উদ্বেগে পড়েছে যুক্তরাজ্যের মুসলিম ও বাংলাদেশি কমিউনিটি। অনলাইনে মুসলিম ডেটিং আর ম্যারেজ মিডিয়ার সংখ্যা বাড়লেও কমছে সংসারের স্থায়িত্ব। বিচ্ছেদ হওয়া মা-বাবার সন্তানরা মানসিক দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। ডিভোর্সি সন্তান নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকছেন অভিভাবকরা।
লন্ডনের ক্রয়োডন এলাকার একটি মসজিদের ইমাম মো. আবু সোলায়মান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রতিদিন কমিউনিটির বহু যুগল আসেন মুসলিম রীতিতে বিয়ে পড়াতে। কিন্তু এর চেয়ে তিন গুণ বেশি মুসলিম নারী-পুরুষ আসেন বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য। পরিস্থিতি এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে, প্রতিটি বিয়ের ক্ষেত্রে আমাদের প্রথম দোয়া বা কামনা থাকে বিয়েটি যেন টিকে থাকে।’
বাঙালি কমিউনিটিতে অনিবন্ধিত বিয়ে আর ফোর্স ম্যারেজের সংখ্যাও বাড়ছে। সম্প্রতি ফোর্স ম্যারেজের দায়ে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মা-বাবার কারাদণ্ডাদেশ দেন বিলেতের একটি আদালত। অন্যদিকে ম্যারেজ রেজিস্টারে নিবন্ধনবিহীন বিয়ে পড়ালে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে শাস্তির মুখোমুখি করার আইন করা হচ্ছে।
গত ৫ জুন এ আইনের পাবলিক কনসালটেশন শেষ হয়েছে। প্রস্তাবিত আইনে ধর্মীয় রীতিতে বিয়ে করে তা একই দিনে ম্যারেজ রেজিস্টারে নিবন্ধনের বিধান রাখা হয়েছে। এ ছাড়া মুসলিম নারীদের শরিয়া কাউন্সিলের পরিবর্তে ব্রিটেনের প্রচলিত আইনি প্রক্রিয়ায় বিবাহ-বিচ্ছেদের অধিকারের প্রস্তাব করা হয়েছে।
এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ব্রিটেনে প্রায় এক লাখ মুসলিম বিয়ের আইনি নিবন্ধন নেই।
গত মে মাসে বার্মিংহামের একটি মেয়েকে পাকিস্তানে নিয়ে বিয়ে দেওয়া হয়। একই সময়ে অন্য মামলায় লিডস থেকে মেয়েকে বাংলাদেশে নিয়ে জোরপূর্বক বিয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মা-বাবার বিরুদ্ধে।
ইউনিভার্সিটি অব ব্রিস্টল ও সেন্টার ফর জেন্ডার অ্যান্ড ভায়োলেন্স রিসার্চের একটি গবেষণায় জোরপূর্বক বিয়েকে লিঙ্গ বৈষম্য এবং অসমতার একটি অংশ হিসেবে দেখানো হয়েছে।
জোরপূর্বক বিয়ের শিকার ব্রিটিশ এশিয়ান এক নারী বলেছেন, ‘আমার ব্রিটিশ বন্ধুরা খুবই উদ্বিগ্ন ছিল, তারা জানতো না আমার সঙ্গে কী ঘটেছিল... আমি তাদের চিঠি লিখতাম, তবে সেগুলো আদৌ তাদের কাছে পৌঁছুতো কিনা, তা ছিল আমার অজানা।’
১৩ বছর বয়সে জোরপূর্বক বিয়ে করতে বাধ্য হওয়া এশীয় বংশোদ্ভূত আরেক নারী (৩০) সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘যেহেতু আমি আমার ঘর ছেড়ে এসেছিলাম, আমাকে সিদ্ধান্তটা বাছতে হয়েছিল... কারণ আমার সংস্কৃতি, আমার পরিচয় সবটা কেড়ে নেওয়া হয়েছিল... আমি ভাইবোনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি। আমার মতে, এটা অন্যায়।’
ব্রিটেনের বাংলাদেশিসহ মুসলিম কমিউনিটিতে ডিভোর্সের হারও বাড়ছে। ‘চ্যানেল ফোর’ পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, ১ হাজার ব্রিটিশ মুসলিম নারীর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কেবল ধর্মীয় রীতিতে বিবাহিত। ব্রিটেনের ম্যারেজ রেজিস্ট্রি অফিসে সেগুলো নিবন্ধিত নয়।
সম্প্রতি আরব নিউজে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কমিউনিটিতে মুসলিম ম্যারেজ বা 'নিকাহ'র সংখ্যা যেমন বাড়ছে, একইসঙ্গে এ বিয়েগুলো বিচ্ছেদে গড়াচ্ছে ইংলিশ ডিভোর্স বা আদালতে আইনি প্রক্রিয়ায়।
বেগম মিয়া নামের এক ব্রিটিশ বাংলাদেশি নারী যোগাযোগ করেন ব্রিটিশ সিভিল কোর্টে। লন্ডনে বসবাসরত ওই নারী জানতে পারেন, তার স্বামী ইসলামিক বিয়ের শুরুতে দেনমোহরের বিষয়টি গোপন রাখেন। একপর্যায়ে কোনও অর্থ পরিশোধ ছাড়াই তাকে ডিভোর্স দেন।
যুক্তরাজ্যের এসওএএস বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম আইনের বিশেষজ্ঞ সামিয়া বানু বলেন, ‘ইসলামিক বিয়ে এখানে বিয়ের মধ্য দিয়ে আপনাকে সহযোগিতা বা অধিকার দিচ্ছে। পরবর্তীতে সহায়তার সুযোগ কম।’
লন্ডনে কর্মরত পারিবারিক আইনের বিশেষজ্ঞ সিদ্দিক প্যাটেল বলেছেন, ব্রিটেনে ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সী মুসলিম তরুণ-তরুণীদের মধ্যে শুধুমাত্র নিকাহ বা ধর্মীয় রীতিতে বিয়ের প্রক্রিয়া জনপ্রিয়।
ইসলামিক কালচারাল সেন্টার ও লন্ডন সেন্ট্রাল মসজিদের ডিরেক্টর জেনারেল ড. আহমেদ আল দুবায়ান বলেন, ব্রিটিশ মুসলিমদের ধর্মীয় রীতিতে বিয়ের পাশাপাশি সিভিল ম্যারেজও জরুরি।
স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ডিভোর্স হয়েছে গত এক দশকে। ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সের বিপুলসংখ্যক ব্রিটিশ বাংলাদেশি নারী একাকী জীবনযাপন করছেন। সন্তান আছে, অথচ ডিভোর্সড— এমন নারী-পুরুষের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে।
লন্ডনে বিয়েসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ভিডিওগ্রাফিসহ ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে নাহিদ জায়গীরদারের। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিয়ের ভিডিও ও ছবি এডিট হয়ে বর-কনের হাতে পৌছুঁবার আগেও বিচ্ছেদ ঘটছে।’
একজন ব্রিটিশ বাংলাদেশি নারী কাউন্সিলার ও সিঙ্গেল প্যারেন্ট নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘বনিবনা না হওয়া সংসার ভাঙার মূল কারণ। কেন বনিবনা হচ্ছে না, সেটি একেক জনের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি একেক রকম।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ও কমিউনিটি নেতা ফয়সল রহমান বলেন, ‘এখানকার বাঙালিরা একইসঙ্গে ব্রিটিশ, বাংলাদেশি ও মুসলিম ভ্যালুজ ধারণ করেন। ব্রিটিশ ও ইংলিশ সংস্কৃতির সঙ্গে একধরনের সাংঘর্ষিকতা এবং একইসঙ্গে ধারণ করার একধরনের দ্বৈত প্রবণতাও আছে। পাশাপাশি দেশটির বেনিফিট সিস্টেম, সিঙ্গেল মায়ের জন্য সরকারি সহায়তার হার কয়েক গুণ বেশি থাকা, সামাজিক অস্থিরতাও বিয়ে বিচ্ছেদের হার এত বাড়ার কারণ।’
সাফিয়াহ রহমান নামে একজন সমাজকর্মী বলেন, দেখা যাচ্ছে ৫ বছর বা তার চেয়েও বেশি সময় তারা একে অপরকে চেনেন। কিন্তু বিয়ের পরই শুরু হচ্ছে সমস্যা। দুজনেরই অভিযোগ, সঙ্গী পাল্টে গেছেন। এখান থেকে মূলত বিবাদের শুরু।’
সলিসিটর বিপ্লব কুমার পোদ্দার বলেন, ‘মা-বাবার সেপারেশন বা ডির্ভোসে সন্তানরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’