সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩৮ নং ওয়ার্ডে কাপ্তান বাজার সংলগ্ন মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের নিচের জায়গা দখল করে অর্ধশতাধিক মুরগির দোকান গড়ে উঠেছে। এসব দোকানে মুরগি নেওয়ার জন্য শতশত ভ্যানগাড়ি রাস্তাদখল করে দাঁড়িয়ে থাকে। পাশাপাশি লেগুনা স্ট্যান্ডেও পরিণত হয়েছে এই স্থানটি। এছাড়া কাপ্তান বাজারে একটি পশু জবাইখানা থাকলেও জবাইখানার বাইরে পশু জবাই করা হচ্ছে। এসব দোকান ও জবাইখানায় উৎপাদিত বর্জ্যের কারণে রাষ্ট্রপতির কার্যালয় বঙ্গভবন সংলগ্ন সড়ক ও আশাপাশের পরিবেশ দূষিত হয়ে পড়েছে।
বঙ্গভবনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানিয়েছেন, রাষ্ট্রপতির কার্যালয় থেকেও এসব বর্জ্যের দুর্গন্ধ পাওয়া যায়। এসব দোকানকে রাষ্ট্রপতি কার্যালয়ের নিরাপত্তার জন্যও অন্তরায় হিসেবে দেখা হচ্ছে। এসব অবৈধ স্থাপনা ও জবাইখানার বাইরে পশু জবাইকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াসহ ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালনার জন্য রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে ডিএসসিসিকে চিঠি পাঠিয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে ডিএসসিসির অতিরিক্ত প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা খন্দকার মিল্লাতুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, 'আমরা কাজ শুরু করে দিয়েছি। নিয়মিত ব্লিচিং পাউডার ছিটানো হচ্ছে। অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হচ্ছে। এখন পরিবেশ অনেক সুন্দর।’
তবে বৃহস্পতিবারও (৯ আগস্ট) বঙ্গভবনের আশপাশের এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে বেহাল চিত্র। যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে লেগুনা। খোলা রয়েছে অবৈধ মুরগির দোকান। চারদিকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। কয়েকজন দোকানি বলেন, ‘ডিএসসিসির লোকজন এলে আমরা বন্ধ করে দেই। চলে গেলে আবার দোকান খুলি।’
ওই ভবনগুলোর মধ্যে ব্যক্তিমালিকানাধীন একাধিক ভবনসহ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের দিলকুশা এলাকায় একটি বহুতল বিশিষ্ট কার পার্কিং-কাম-বাণিজ্যিক ভবন (সানমুন স্টার টাওয়ার), রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) মূল ভবন এবং সোনালী ব্যাংকের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ অসংখ্য স্থাপনা রয়েছে। এছাড়া বর্তমানে বেশ কিছু ভবন নির্মাণাধীন রয়েছে। ভবনগুলোর কাজ দ্রুত বন্ধ করার ব্যাপারেও ডিএসসিসি ও রাজউককে অনুরোধ করেছিল রাষ্ট্রপতির কার্যালয়। কিন্তু এর পরেও টনক নড়ছে না ডিএসসিসির।
২০১৩ সালের কেপিআই (কি পয়েন্ট ইনস্টলেশন) নিরাপত্তা নীতিমালা অনুযায়ী কেপিআইভুক্ত ভবনের ৩০০ মিটার দূরত্বের মধ্যে কোনও প্রকার ভবন থাকতে পারে না। বিশেষ প্রয়োজনে এ এলাকায় কোনও স্থাপনা নির্মাণের প্রয়োজন হলে তা কেপিআই ডিফেন্স কমিটি থেকে পৃথকভাবে অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু বঙ্গভবনের পাশে গড়ে ওঠা সানমুন স্টার টাওয়ারসহ অন্যান্য ভবনের ক্ষেত্রে এ নীতিমালা অনুসরণ করা হয়নি।
সূত্র জানায়, বিশেষ শ্রেণির কেপিআই হিসেবে ২০১৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি বঙ্গভবনে পূর্ত মন্ত্রণালয়, রাজউক, ডিএসসিসি, সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সানমুন স্টার টাওয়ারটির নির্মাণ অনুমোদনে সিটি করপোরেশনের বেশ কিছু ত্রুটি ও দুর্বলতাকে দায়ী করা হয়। এ অনুমোদন প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা কর্মচারীদের কোনও ত্রুটি বা গাফিলতি রয়েছে কিনা তা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও ডিএসসিসিকে অনুরোধ করা হয়। এ বিষয়ে গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়কে জানাতেও বলা হয়েছে।
রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের এমন নির্দেশের পর ডিএসসিসি’র তৎকালীর প্রশাসক মো. ইব্রাহীম হোসেন খানের নির্দেশে সংস্থার প্রধান প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম একটি তদন্ত করেন। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স এমআর ট্রেডিং কোং লি. কর্তৃক লেটার অব একসেপটেন্স এবং চুক্তিনামার শর্ত প্রতিপালন, ভবন নির্মাণের নকশা রাজউক কর্তৃক অনুমোদন গ্রহণ ও বহুতল ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বিশেষ শ্রেণির কেপিআইয়ের ছাড়পত্র গ্রহণ করা হয়নি।
সিটি করপোরেশনের এ প্রকল্পটি নিয়ে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের নির্দেশে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব আবুল কাশেম আরো একটি তদন্ত করেন। তার তদন্তেও বেশকিছু অনিয়ম ধরা পড়ে। এতে বলা হয়, মন্ত্রণালয় বা প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন ছাড়াই সিটি করপোরেশনের ২৩ কোটি ৬১ লাখ টাকা ব্যয় ও অর্থায়ন প্রসঙ্গে খেয়াল খুশিমতো অনুমোদনহীন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন, পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রেগুলেশন লঙ্ঘন করে প্রকল্পের কাজ ভাগ করে ক্রয় চুক্তি সম্পাদন, ক্রয় চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন, মামলা করার সুযোগ সৃষ্টি, সিটি করপোরেশনের স্বার্থ রক্ষার্থে মামলা প্রতিদ্বন্দ্বিতার অভাব, বিধি বহির্ভূত দরপত্র দাখিলের ভিত্তিতে দরপত্র প্রক্রিয়াকরণ, দরপত্র গ্রহণের পর মূল্যায়ন কমিটি পুনর্গঠন, বিধি বহির্ভূত ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে চুক্তির শর্তসহ সোলেনামা স্বাক্ষর ও আদালতে দাখিল, আমমোক্তার নিয়োগ ইত্যাদি গুরুতর অনিয়ম পাওয়া গেছে। এর সঙ্গে জড়িত ও দায়ী কর্মকর্তারা হচ্ছেন- ডিএসসিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক মো. সেহাব উল্লাহ, নির্বাহী প্রকৌশলী নুরুল আমিন, সহকারী প্রকৌশলী মফিজুর রহমান খান ও আবুল কালাম মো. আজাদ, ভারপ্রাপ্ত আইন কর্মকর্তা এমএস করিম, সহকারী সচিব মো. জুনায়েদ আমিন।
এতে আরও বলা হয়, দায়িত্বে অবহেলা, অসদাচরণ, অদক্ষতা ও আর্থিক ক্ষতির দায়ে নির্বাহী প্রকৌশলী মনসুর আহমেদ উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. আনিসুর রহমান ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ন্যস্ত হওয়ার পর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. সেহাব উল্লাহ, সহকারী প্রকৌশলী মফিজুর রহমান খানের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে পরিচালিত হয়। এরপরও তদন্ত কর্মকর্তার অনুমোদিত সিদ্ধান্ত এখনও কার্যকর করা হয়নি। এই কর্মকর্তারা বহাল তবিয়তেই রয়েছেন। আশানুরূপ কোনও অগ্রগতি না হওয়ায় ওই বছরের ৩ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতির কার্যালয় থেকে ডিএসসিসিসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও একটি চিঠি দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, একই বিষয়ে বার বার অনুরোধ করা হলেও এখন পর্যন্ত আশানুরূপ কোনও অগ্রগতি হয়নি। পরবর্তী ৭ কার্যদিবসের মধ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ বা অগ্রগতি সম্পর্কে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়কে জানাতে বলা হয়। এর পরেও টনক নড়েনি ডিএসসিসির। দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা না নিয়ে তাদের বিভিন্ন সময়ে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নুরুল আমিনকে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্বে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে তিনি অবসরে রয়েছেন।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসসিসি সচিব মো. শাহাবুদ্দিন খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের আশপাশে বিভিন্ন দোকান ও অবৈধ স্থাপনা অপসারণ করার জন্য যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সেটা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ওই স্থানগুলো থেকে কোনও দুর্গন্ধ ছড়াবে না। আমরা নিয়মিত কাজ করছি।’ আর বহুতল ভবন নির্মাণে জড়িত থাকা দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে রাষ্ট্রপতি কার্যালয়ের যে নির্দেশ রয়েছে সে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা তো অনেক আগের ঘটনা। আমার সময়ে নয়। সেটার বিষয়ে একটু খোঁজখবর নিতে হবে।’