৩০ হাজার টাকায় মেলে মন্ত্রীর জাল স্বাক্ষর!

সিআইডির হেফাজতে মন্ত্রীর স্বাক্ষর জালকারী প্রতারক চক্রের তিন সদস্য

মাত্র ৩০ হাজার টাকায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমসহ একাধিক মন্ত্রীর স্বাক্ষর জাল করে নার্সদের প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশে পাঠানোর কথা আদালতে স্বীকার করেছে একটি প্রতারক চক্র। মন্ত্রী ছাড়াও সচিবদের স্বাক্ষরও জাল করার কথা স্বীকার করেছে এই চক্রের দুই সদস্য।

২০১৬ সালে শেরে বাংলানগর থানায় নার্সিং ও মিডওয়াইফারি (সেবা অধিদফতর) অধিদফতরের তৎকালীন পরিচালক নাসিমা পারভীনের দায়ের করা একটি মামলার তদন্তের সূত্র ধরে এই চক্রের চারজনকে গ্রেফতার করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। গ্রেফতার চারজনের মধ্যে দুজন আদালতে মন্ত্রীদের স্বাক্ষর জাল করার কথা স্বীকার করেছে।

সিআইডির তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সরকারি ব্যবস্থাপনায় নার্সদের স্বল্পমেয়াদে স্পেশালাইজড কোর্সে বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য ২০১৬ সালে সরকার সার্কুলার দেয়। এরপর সারাদেশ থেকে উপযুক্ত নার্সরা আবেদন করেন। প্রতিবছর অন্তত ১০ জন করে নার্সকে সরকারি ব্যবস্থাপনায় বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য এভাবে পাঠানো হয়। মালয়শিয়ায় এই প্রশিক্ষণ বেশি হয়ে থাকে। এছাড়া, আরও কয়েকটি দেশে নার্সদের প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয়। নার্সরা প্রশিক্ষণ শেষে এককালীন একলাখ টাকা পেয়ে থাকেন। একারণে নার্সদের প্রশিক্ষণে যাওয়ার আগ্রহ থাকে। তাদের এই আগ্রহের সুযোগ নেয় প্রতারক চক্র। সেবা অধিদফতর ও বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে কর্মচারীদের মধ্যেই গড়ে উঠেছে এই প্রতারক চক্র।’

সিআইডি’র কর্মকর্তা বলেন, ‘২০১৬ সালে সেবা অধিদফতরের অফিস সহকারী ছিলেন মো. আব্দুল কুদ্দুস মিয়া। তার সঙ্গে পরিচয় হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী (স্টুয়ার্ড) আনিসুজ্জামানের। এই আনিসুজ্জামান নিজেকে প্রভাবশালী বলে পরিচয় দেন আব্দুল কুদ্দুস মিয়ার কাছে। তার সঙ্গে অনেক মন্ত্রী ও সচিবের সম্পর্ক আছে। বিদেশে নার্স পাঠানোর ক্ষেত্রে তিনি ভূমিকা রাখতে পারেন। এরপর তারা  দুজনে মিলে নার্সদের কাছ থেকে আবেদন সংগ্রহ করেন। একাজে আরও কয়েকজন তাদের সহযোগিতা করেছেন। আবেদনপত্রের ওপরে বিভিন্ন মন্ত্রীর জাল স্বাক্ষর ও সিল মেরে সেগুলো সেবা অধিদফতরে জমা দেওয়া হয়। আবেদন পত্র জমা দেওয়ার জায়গায় সিসি ক্যামেরা থাকায় অফিস সহকারী নিজে আবেদন পত্র  জমা দিতেন না। আনিসুজ্জামানকে দিয়ে ওই বছর (২০১৬) সব আবেদনপত্র জমা দেওয়া হয়।’

সেবা অধিদফতরে জমা হওয়া আবেদনপত্রগুলো  যাচাই-বাছাই করে দেখা যায়, ১৭ জন ষ্টাফ নার্সের আবেদনে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, রেলমন্ত্রী, খাদ্যমন্ত্রী, সংসদ সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, শেখ ফজলে নূর তাপস, ফজলে হোসেন বাদশাহসহ কয়েকজন সচিবের সিল ও স্বাক্ষরসহ সুপারিশ রয়েছে, যা দেখে পরিচালক নাসিমা পারভীনের সন্দেহ হয়। একই সময় বিভিন্ন অপরিচিত নম্বর থেকে নাসিমা পারভীনকে ফোন দিয়ে একব্যক্তি নিজেকে বিভিন্ন মন্ত্রী ও সচিব পরিচয় দিয়ে আবেদনের বিষয়ে তদবির করতেন। এতে করে নাসিমা পারভীনের সন্দেহ আরও বেড়ে যায়। এরপর তিনি নিজে সচিবালয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন,আসলে তাকে কোনও মন্ত্রী বা সচিব ফোন দিতেন না। এরপর তিনি শেরে বাংলানগর থানায় ২০১৬ সালের ১৭ আগস্ট একটি মামলা দায়ের করেন। মামলা নম্বর ১৭। এবছরের ১২ আগস্ট মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পায় সিআইডি। তারা এ মামলার তদন্ত করতে গিয়ে জানতে পারে মূল হোতাদের কথা।

সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম (সিরিয়াস ক্রাইম স্কোয়াড) এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাজিব ফারহান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের স্টুয়ার্ড আনিসুজ্জামান বিভিন্ন অনিবন্ধিত ও চোরাই সিম থেকে বিভিন্ন মন্ত্রীর পরিচয়ে তৎকালীন পরিচালককে ফোন দিতেন। তাকে প্রথমে গ্রেফতার করা হয়।তিনি মূলত স্বাক্ষর জাল করতেন। আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন। আনিসুজ্জামান ছাড়াও সেবা অধিদফতরের অফিস সহকারী আব্দুল কুদ্দুস মিয়া এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত। তারা প্রার্থীদের কাছ থেকে ৩০ হাজার করে টাকা নিতেন।বিনিময়ে তারা এই জালিয়াতি করতেন।’

রাজিব ফারহান বলেন, ‘আমরা ১৭ জন নার্সকে পেয়েছি, যারা জালিয়াতির মাধ্যমে প্রশিক্ষণের সুবিধা নিয়েছিলেন। আমরা তাদের চিহ্নিত করেছি। তারাও অপরাধী। কারণ, তারা জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছিলেন। তবে মূল হোতাদের গ্রেফতারের জন্য আমরা এতদিন প্রার্থীদের গ্রেফতার করিনি। এখন মূল হোতাদের চারজনকে গ্রেফতার করেছি। তাদের মধ্যে আব্দুল কুদ্দুস ও আনিসুজ্জামান আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তারা জালিয়াতির কথা স্বীকার করেছেন।’

সিআইডির ধারণা, এই জালিয়াত চক্রটি আগেও এভাবে নার্সদের প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশে পাঠিয়েছে। তাদের সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। গ্রেফতার অন্য দু’জন হলো—  সিনিয়র স্টাফ নার্স আবু ইউসুফ (৩৬) ও  সিনিয়র স্টাফ নার্স মো. রুহুল বাসার তালুকদার (৪৫)। গত ১৩ আগস্ট তাদেরকে চাঁদপুর ও কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করা হয়। তারা জালিয়াত চক্রের সঙ্গে জড়িত। গ্রেফতার আসামিদের মধ্যে আনিসুজ্জামান বর্তমানে জামিনে রয়েছেন। বাকিরা কারাগারে আছেন।

সিআইডি’র এই কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মামলার তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। আরও কিছু তথ্য যাচাই-বাছাই এবং জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে যারা সুবিধা নিয়েছেন, তাদের বিষয়েও তথ্য সংগ্রহ চলছে। এরপর অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে।’

এবিষয়ে মামলার বাদী নাসিমা পারভীনের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে মামলার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি একটি মামলা দায়ের করেছিলাম। সেটি তদন্ত করছে পুলিশ।’