স্বপ্ন চোখে বিদেশ যাত্রা, শূন্য হাতে ফেরা

বিমানবন্দরে সৌদি আরব ফেরত দুই নারী শ্রমিক

উন্নত জীবন গড়ার স্বপ্ন এবং বুক ভরা আশা নিয়ে বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যে যান নারী শ্রমিকরা। কিন্তু সবার ভাগ্য সহায় হয় না, তাই ফিরে আসতে হয় দেশে। তাও আবার শূন্য হাতে। শুধুমাত্র একটি প্লাস্টিকের ব্যাগে নিজের কাপড়টুকু সঙ্গে নিয়ে দেশে ফিরে আসেন তারা। এমনকি তাদের পাসপোর্টটিও সঙ্গে আনতে পারেন না। তাই দূতাবাস থেকে আউট পাস দিয়ে তাদের দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

মঙ্গলবার (১৮ সেপ্টেম্বর ) রাতে এমনই ৪১ জন নারী শ্রমিক দেশে ফিরে এসেছেন। রাত ১১টার কিছু পরে এয়ার অ্যারাবিয়া’র একটি ফ্লাইটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান তারা।

দেশে ফিরে এসব নারী শ্রমিকরা জানাচ্ছেন, ভয়াবহ নির্যাতনের পাশাপাশি তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া অমানবিক ঘটনাগুলো। চুক্তির নির্দিষ্ট সময়ের আগেই যারা ফিরে আসেন তারা বেশিরভাগই পাসপোর্ট সঙ্গে করে নিয়ে আসতে পারছেন না। পাসপোর্ট রেখে দিয়েছে নিয়োগকর্তা। এমনকি এই নারী শ্রমিকরা কোন রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে গিয়েছিলেন তার নামও ঠিকমতো বলতে পারেন না।

জানা যায়, সৌদি আরবে গৃহকর্মীর কাজকে বলা হয় খাদ্দামা। এই খাদ্দামার কাজে গিয়েই নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরে আসেন নারী শ্রমিকরা। মঙ্গলবার রাতে ফিরে আসা নারী শ্রমিক ঝিনাইদহের জেবুন্নেসা তাদেরই একজন। তিনি জানান, গত বছরের রোজার মাসে খাদ্দামার কাজ নিয়ে গিয়েছিলেন রিয়াদে। বেতন চাওয়ায় তাকে সহ্য করতে হয়েছে নিয়োগকর্তার শারীরিক নির্যাতন। নির্যাতনের এক পর্যায়ে তার শরীরের হাত এবং পা ফুলে গিয়েছিল বলেও জানান তিনি।

এয়ারপোর্টে জেবুন্নেসা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কাজ করাইতো বেশি, আবার খাওয়া ঠিক মতো দিতো না। ফজরের নামাজের আগে উঠতাম, আর অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করতাম। খাইতে দিতো না ঠিক মতো, দেশে ফোন দিয়ে কথা বলতে চাইলে তা দিতো না। বেতন চাইলেই মারতো, মাইরের চোটে শরীরের হাত পা ফুইলা যাইতো।’

এরপর কী হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমারে পুলিশে দেয়। পাঁচ মাস জেল খাটছি আমি। এরপর আমারে সফর জেলে (সৌদি সরকারের ডিপোর্টেশন সেন্টার) দেয়, সেখান থেকে দেশে পাঠায় দিসে।’

বেতন চাইলে শারীরিক নির্যাতন করার অভিযোগ বিক্রমপুরের রত্নারও। মঙ্গলবার দেশে ফিরে এসে তিনিও বলেছেন অবর্ণনীয় নির্যাতনের কথা। রত্নার কাছে জানা যায়, মাত্র ৩ মাস ২০ দিন আগে সৌদি আরব যান তিনি। একমাস কাজ করেন নিয়োগকর্তার বাসায়। বাকি সময় কাটিয়েছেন জেলে।

জেলে থাকার কারণ জানতে চাইলে রত্না বলেন, ‘মালিকের বাসায় একমাস কাজ করছিলাম। দিন রাত কাজ করায় অথচ খাইতে দেয় না ঠিকমতো। বেতন চাইছিলাম, মাইরা পুলিশে দিসে। এরপর থেকেই জেলে।’

শুধু শারীরিক নির্যাতন নয়, মানসিক নির্যাতনে বিপর্যস্ত হন অনেকেই। জানা যায়, মঙ্গলবার রাতের ফ্লাইটে ৪২ জন ফিরে আসার কথা থাকলেও একজন দেশে ফিরতে পারেননি। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে উদ্ভট আচরণ করায় তাকে আটকে রেখেছে শারজাহ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পুলিশ। এর আগে বৃহস্পতিবার রাতের ফ্লাইটে ফিরে আসা নারী শ্রমিকদের একজন সুনামগঞ্জের রুজিনাকে দেখা গেছে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে এয়ারপোর্টে উদ্ভট আচরণ করতে। তার সফর সঙ্গীরা জানান, রিয়াদে থাকার সময় থেকেই তার এই অবস্থা। কিছু সময় ঠিক থাকেন আবার কিছু সময় পর শুরু হয় তার পাগলামি।

জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি)-এর দেওয়া তথ্য মতে, এই বছরের আগস্ট পর্যন্ত প্রায় ৬৭ হাজার নারী শ্রমিক বিদেশে গেছেন। এর মধ্যে ৪৯ হাজার ৬৭০ জন নারী গেছেন সৌদি আরবে। আবার সৌদি আরব থেকে ফিরে আসা নারী শ্রমিকের সংখ্যাও সবচেয়ে বেশি। ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই বছরেই ফিরে এসেছেন প্রায় ১ হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার নারী শ্রমিক। এদের মধ্যে গত চার মাসেই দেশে ফিরেছেন প্রায় ৭৫০ থেকে ৮০০ নারী শ্রমিক।

প্রসঙ্গত; সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান, কাতার, বাহরাইন, লেবাননসহ বিশ্বের ১৮টি দেশে যাচ্ছেন বাংলাদেশি নারী শ্রমিকরা। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নারী শ্রমিক যান সৌদি আরবে। আবার নানা কারণে নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার আগে সেখান থেকেই সবচেয়ে বেশি নারী ফেরত আসেন। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) দেওয়া তথ্যমতে- ২০১৭ সালে অভিবাসী নারীর সংখ্যা ছিল ১২ লাখ ১৯ হাজার ৯২৫ জন, যা মোট অভিবাসনের ১৩ শতাংশ। যা এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি। তবে কোনও সংস্থা কিংবা মন্ত্রণালয়, কারও কাছে এই ফেরত আসা নারী শ্রমিকের বিষয়ে সঠিক কোনও তথ্য নেই।

১৯৯১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত একা অভিবাসন প্রত্যাশী নারী শ্রমিককে অভিবাসনে বাধা দেওয়া হলেও প্রথমে ২০০৩ এবং পরে ২০০৬ সালে তা আরও  কিছুটা শিথিল করা হয়। ২০০৪ সালের পর থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত নারী শ্রমিকের অভিবাসন হার ক্রমাগত বাড়তে থাকে। ২০১৫ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ায় মোট অভিবাসনের ১৯ শতাংশে। তবে ২০১৬ সালে অভিবাসী নারী শ্রমিকের সংখ্যা নেমে আসে ১৬ শতাংশে এবং ২০১৭ সালে ১৩ শতাংশে।    

বিমানবন্দরের প্রবাস কল্যাণ ডেস্ক থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী-এই বছরের ৩ মে ৩৫ জন, ১২ মে ২৭ জন, ১৯ মে ৬৬ জন, ২৩ মে ২১ জন, ২৭ মে ৪০ জন এবং ৩ জুন ২৯ জন, ১৮ জুন ১৬ জন, ১৯ জুন ২৭ জন, ২৬ জুন ২২ জন, ১০ জুলাই ৪২ জন, ২১ জুলাই ৩৪ জন, ২৮ জুলাই ৪২ জন ও ৩ আগস্ট ২৮ জন নারী শ্রমিক দেশে ফিরেছেন। তবে এর বাইরে আরও নারী শ্রমিক দেশে ফিরে এসেছেন বলে বিভিন্ন মাধ্যম হতে জানা গেছে।