রাজধানীর সড়কে শৃঙ্খলা আনতে বাস রুট রেশনালাইজেশনের দায়িত্ব দিয়ে গত ৯ সেপ্টেম্বর প্রজ্ঞাপন জারি করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। ১০ সদস্যের এ কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকনকে। প্রজ্ঞাপনে বেশ কয়েকটি দায়িত্বের কথা বলা হয়। দায়িত্বগুলোর মধ্যে, ঢাকা মহানগরীর যানজট নিরসনে বাস রুট রেশনালাইজেশন ও কোম্পানির মাধ্যমে বাস পরিচালনা পদ্ধতি প্রবর্তনের বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক যেসব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন সেগুলো বিবেচনায় নিয়ে কার্যক্রম গ্রহণ, সংশ্লিষ্ট অংশীজনের মাধ্যমে বাস রুট রেশনালাইজেশন ও কোম্পানির মাধ্যমে বাস পরিচালনা পদ্ধতি প্রবর্তন ও এ পদ্ধতি প্রবর্তনে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা। এছাড়া এসব বিষয়ের সঙ্গে জড়িত অন্যান্য কার্যক্রমসহ কমিটির কার্যক্রম প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ এবং সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগকে নিয়মিত অবহিত করার কথাও বলা হয়েছে প্রজ্ঞাপনে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাস রুট রেশনালাইজেশন বিষয়ে প্রাইভেটকার বা রিকশা নিয়ন্ত্রণে আমাকে কোনও ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। কোনও বিষয়ে নির্দিষ্ট করে ক্ষমতাও দেওয়া নেই। তবে বিষয়গুলো নিয়ে আমরা কমিটির বৈঠকে আলাপ-আলোচনা করতে পারি। আমরা কমিটির সিদ্ধান্তগুলো প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ এবং সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগকে নিয়মিত অবহিত করবো।’
এর আগে গত বছরের ২৭ জুন, সেবাদানকারী ২৬টি সংস্থার মধ্যে সমন্বয় করার জন্য মেয়র সাঈদ খোকনকে দায়িত্ব দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল। এতে বলা হয়, ‘সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত সেবা প্রদানকারী সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সরকারি দফতরের প্রধানরা সিটি করপোরেশনের আমন্ত্রণে সভায় যোগদান করে সভার গৃহীত সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন এবং বাস্তবায়নের অগ্রগতি সিটি করপোরেশনকে অবহিত করবেন।’ কিন্তু সেবা সংস্থাগুলোর প্রধানরা করপোরেশনের আমন্ত্রণে সভায় যোগদান না করলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে কোনও নির্দেশনা বা ক্ষমতা দেওয়া হয়নি।
এদিকে বাস রুট রেশনালাইজেশন নিয়ে গঠিত কমিটির বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে গত ১০ সেপ্টেম্বর নগর ভবনে এক সংবাদ সম্মেলন করেন ডিএসসিসি মেয়র সাঈদ খোকন। সেদিন বিষয়গুলো নিয়ে তার কাছে গণমাধ্যমকর্মীরাও বেশ কয়েকটি প্রশ্ন করেন। বিশেষ করে, সেবা সংস্থাগুলোকে নিয়ে গঠিত সমন্বয় সভায় অন্যান্য সেবা সংস্থার প্রধানরা আসেন না। তারা এমন কাউকে পাঠান যাদের নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। সেক্ষেত্রে সভা সেভাবে কার্যকর হয় না। বর্তমানে যে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে তাতেও কমিটির অন্যান্য সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধানরা যদি না আসেন সেক্ষেত্রে আপনি কী ব্যবস্থা নিতে পারবেন- সে বিষয়ে প্রজ্ঞাপনে কিছুই উল্লেখ নেই। সেক্ষেত্রে এই প্রজ্ঞাপন কতটুকু কার্যকর হবে জানতে চাইলে মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, ‘এমন আশঙ্কা হতেই পারে। কোনও কাজ ম্যাজিকের মতো করে ফেলতে পারবো সেটাও আমরা আশা করি না। আমরা যেকোনো কাজ করতে চাইলে তাতে বিভিন্ন রকমের প্রতিবন্ধকতা ও চ্যালেঞ্জ দেখা দেয়। এর মধ্যেই আমাদের এগিয়ে যেতে হয়। আমাদের যে সমন্বয় কমিটি করা হয়েছে সেখানে যথাযোগ্য উপস্থিতির সংখ্যা অত্যন্ত কম। তাই বলে আমরা থেমে থাকিনি। আমাদের এই কার্যক্রম চলছে এবং চলবে। কীভাবে সমস্যার সমাধান করে এগিয়ে যাওয়া যাবে সেটাই আমাদের মূল লক্ষ্য।’
এ বিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থাপনার জন্য ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) রয়েছে। সরকারের দায়িত্ব হবে এই সংস্থাটির কারিগরি দক্ষতা বাড়ানো। সঠিক অর্গানোগ্রাম তৈরি করতে হবে। এই সংস্থা থাকার পরেও কেন আলাদা করে কাউকে দায়িত্ব দিতে হবে? যাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তার কোনও কারিগরি দক্ষতা আছে? সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আছে? যদি না থাকে তাহলে এমন সিদ্ধান্ত অনর্থক। যেখানে ডিটিসিএ রয়েছে সেখানে এ ধরনেরর কমিটি যথার্থ নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘মেয়রকে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সেই কারিগরি জ্ঞান তার নেই। তার পক্ষে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব না। এই কমিটির সঙ্গে যেসব ব্যক্তি বা সংস্থা রয়েছে তারা তার কথা শুনবে বলে মনে হয় না। তবে কমিটিতে সবাইকে নিয়ে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সেটা এক ধরনের উদ্যোগ কিন্তু তা বাংলাদেশের বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য নয়। এখন দায়িত্ব যখন দেওয়া হয়েছে তাকে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের বিষয়ে ক্ষমতাও দিতে হবে।’
এই পরিকল্পনাবিদের মতে, যানজট নিরসনে রাজধানীর সড়ক পরিবহন সেক্টর নিয়ে ২০০৫ সালে তৈরি করা স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যানে (এসটিপি) বাস রুট রেশনালাইজেশনের বিষয় রয়েছে। তাহলে এটা কীভাবে আনিসুল হকের পরিকল্পনা হয়? সেই এসটিপি বাস্তবায়ন করলেই তো হয়ে যায়।
তবে বিষয়টি নিয়ে ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সহ-সভাপতি ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিষয়টি হচ্ছে কমিটি তার দায়িত্ব থেকে সমন্বয় করবে। আর যেকোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য সবগুলো সেবা সংস্থার দায়িত্ব রয়েছে। এটা হতে হবে। তাছাড়া উপায় নেই। আমাদের সকলের জন্যই কাজ করতে হবে যদি এমনটা মূল লক্ষ্য হয় তাহলে ক্ষমতার দরকার পড়বে না। এখানে কেউ দায়িত্বে অবহেলা করলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিস্বরূপ ব্যবস্থা নিতে হবে বিষয়টা এমন না। তবে দেশে যদি নগর সরকার থাকতো তাহলে এই ক্ষমতা তার ওপর অটোমেটিকভাবে চলে আসতো।’
তবে অপর একজন নগর পরিকল্পনাবিদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মেয়র সাঈদ খোকন এই কাজ বাস্তবায়ন করতে পারবেন না। কারণ তাকে শুধু দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, কিন্তু কাজটি বাস্তবায়ন করতে কোনও ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। যেহেতু মেয়রের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি বাস রুট রেশনালাইজেশনের কাজ চূড়ান্ত করবেন সেহেতু তার ওপর কিছু ক্ষমতাও থাকা বাঞ্চনীয়।