এখনও পাঁচ বছরের কমবয়সী শিশুর প্রধান ঘাতক নিউমোনিয়া

বাংলাদেশি মা-বাবারা এখনও শিশুর নিউমোনিয়া সম্পর্কে সচেতন নন

সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও এখনও শিশুমৃত্যুর অন্যতম কারণ নিউমোনিয়া। ইউনিসেফের তথ্যানুযায়ী, বিশ্বজুড়ে নিউমোনিয়া এখনও পাঁচ বছরের কমবয়সী শিশুমৃত্যুর প্রধান কারণ। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বিশ্বে প্রতি ৩৫ সেকেন্ডে ১ জন শিশু  মৃত্যুবরণ করছে। দিনে মৃত্যুবরণ করছে ২ হাজার ৫শ’ শিশু।

এ অবস্থা পরিবর্তনে মা-বাবার মধ্যে এই রোগ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করছেন চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্টরা। পাশাপাশি এই রোগের লক্ষণগুলো দেখা গেলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নিয়ে চিকিৎসা দেওয়ার ব্যাপারেও পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

আজিমপুর নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কাউন্সেলর হাবিবা সুলতানা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, শিশুর শ্বাসতন্ত্রের যে কোনও অংশে হঠাৎ সংক্রমণকে শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ বলে। শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ হলে তার সর্দি, কাশি ও জ্বর হয়। এ অবস্থায় সঠিক যত্ন না নিলে শিশুর নিউমোনিয়া হতে পারে।

তিনি জানান, নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রে যেসব লক্ষণ দেখা যায় সেগুলো হচ্ছে দ্রুত শ্বাস নেওয়া, শ্বাস নেওয়ার সময় বুকের নিচের অংশে দেবে যাওয়া, তরল খাবার পান করতে না পারা বা বুকের দুধ টেনে খেতে না পারা, খাবার বমি করে ফেলে দেওয়া, শিশুর নেতিয়ে পড়া বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া এবং খিঁচুনি।

নিউমোনিয়ার মতো প্রাণঘাতী রোগকে খাটো করে দেখেন না সচেতন অভিভাবকরাও।  সম্প্রতি আজিমপুর নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে কথা হয় তুজজাউন বেগম (৪০) নামে এক গৃহবধূর সঙ্গে। তার পাঁচবছর বয়সী মেয়ের জ্বরের কারণ জানতে এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ছুটে এসেছেন তিনি। চিকিৎসক তার মেয়ের নিউমোনিয়া হয়নি জানালে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন তিনি।

বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ের চার বছর বয়সে ঠাণ্ডা লেগে অনেক জ্বর উঠেছিল। কিছুই খেতে পারতো না। প্রথমে বুঝতে পারিনি। এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ওকে নিয়ে আসার পর ডাক্তার আপা দেখে জানালেন, আমার মেয়ের নিউমোনিয়া হয়েছে। কী যে ভয় পেয়েছিলাম! তার দেওয়া ওষুধ খেয়ে আমার মেয়ে ভালো হয়। এরপর ওর ঠাণ্ডা লাগলেই আমি ভয়ে থাকি।

তিনি বলেন, এই রোগ থেকে মুক্তি পেতে স্তন্যদায়ী মা এবং সন্তানকে ঠাণ্ডা লাগতে দেওয়া যাবে না।

ইউনিসেফের তথ্যানুযায়ী, প্রতি বছর ১০ লাখ শিশুর নিউমোনিয়ার কারণে মৃত্যু হয়। ২০১৫ সালে বিশ্বে ৯ লাখ ২২ হাজার শিশু নিউমোনিয়ায় মৃত্যুবরণ করে। এই সংখ্যা মোট শিশুমৃত্যুর ১৬ ভাগ। এদের মধ্যে ৫ ভাগ শিশু ছিল নবজাতক। তবে আশার কথা হচ্ছে, ২০০০ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে নিউমোনিয়ার বিরুদ্ধে সচেতনতা বেড়েছে। ইউনিসেফের তথ্যানুযায়ী, ২০০০ থেকে ২০১৫-এই ১৫ বছরের মধ্যে আগের তুলনায় ৫১ ভাগ শিশু নিউমোনিয়ায় মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। অবশ্য এই সময়কালে বিশ্বজুড়ে সচেতনতা বেড়েছে ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধেও। ইউনিসেফের তথ্য, সচেতনতা বাড়ায় এই ১৫ বছরে ৮৬ ভাগ শিশু ম্যালেরিয়ায় মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের দি ইনট্রিগ্রেটেড গ্লোবাল অ্যাকশন প্ল্যান ফর দি প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোল অফ নিউমোনিয়া অ্যান্ড ডায়রিয়া (জিএপিপিডি) এর লক্ষ্য হচ্ছে, ২০২৫ সালের মধ্যে প্রতি এক হাজার শিশুর মধ্যে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুহার তিনজনে নামিয়ে আনা, ডায়রিয়ার ক্ষেত্রে যা প্রতি হাজারে ১ জন। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে শিশুরা ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা, এইডস এর চেয়ে বেশি মৃত্যুবরণ করছে। এ রোগ প্রতিরোধে মাত্র ২ ভাগ অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়।

ইউনিসেফের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে ২০১৪ সালে ৫ বছরের কমবয়সী ৪২ ভাগ শিশু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার পর চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা পেয়েছে। ২০০৪ সালে এই হার ছিল ১৯ দশমিক ৯ ভাগ। তবে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ হলেও নিউমোনিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে বাংলাদেশের চেয়েও এগিয়ে রয়েছে আফগানিস্তান। ২০১৫ সালে দেশটির ৬১ দশমিক পাঁচ ভাগ শিশু চিকিৎসকের কাছ থেকে চিকিৎসা পেয়েছে। এছাড়াও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে নিউমোনিয়ার চিকিৎসাসেবায় ইউনিসেফের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যপূরণে সমর্থ হয়েছে কেবল মালদ্বীপ, নেপাল, ভারত ও ভুটান। খুব কাছাকাছি রয়েছে  শ্রীলঙ্কা। তবে ২০০৬-৭ সালে লক্ষ্যপূরণ করার পরেও ২০১২-১৩ সালে লক্ষ্য থেকে পিছিয়ে গেছে পাকিস্তান। একই অবস্থা বাংলাদেশের আরেক প্রতিবেশী মিয়ানমারেরও।

এ রোগ প্রতিরোধ প্রসঙ্গে কাউন্সেলর হাবিবা সুলতানা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, শিশুর যাতে ঠাণ্ডা না লাগে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। বয়স অনুযায়ী তাকে ঘন ঘন বুকের দুধ বা তরল খাবার দিতে হবে, পরিচ্ছন্ন, শুষ্ক এবং বিশুদ্ধ বাতাস চলাচল করে এমন পরিবেশে শিশুকে রাখতে হবে এবং মারাত্মক রোগের যে কোনও একটি লক্ষণ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিশুকে স্বাস্থ্যকেন্দ্র, কমিউনিটি ক্লিনিক বা হাসপাতালে নিতে হবে।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সারা পৃথিবীতেই শিশু মৃত্যুর অন্যতম কারণ নিউমোনিয়া। সেটা পৃথিবীর প্রায় সবদেশেই এই অবস্থা। ইনগ্রেটেড ম্যানেজমেন্ট অব চাইল্ডহুড ইন ইলনেস (আইএমসিআই) নামে আমাদের একটা প্রোগ্রাম আছে। শিশুদের যেসব অসুস্থতা থাকে তার সমন্বিত ব্যবস্থাপনা। এতে বাংলাদেশ সরকার ও ইউনিসেফ সহায়তা করে থাকে। আমাদের এই বিষয়ে প্রথমত শিশুদের টিকা দেওয়া হয়। শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণজনিত এই ধরনের অসুখ সম্পর্কে মা-বাবাকে সচেতন করতে আমাদের প্রোগ্রাম আছে। তাদের এই বিষয়ে সচেতন করে থাকি। সন্তানের মধ্যে এই রোগের লক্ষণগুলো দেখা গেলে মা-বাবাদের সন্তানকে কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা যে কোন হাসপাতালে আনার জন্য বলি।

তিনি বলেন, এটা একটা ভালো খবর যে, এখন মা-বাবাদের অনেকেই সন্তানকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে আসে। তবে, তারপরও সব বাবা-মা যে তাদের অসুস্থ সন্তানকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে আসছে না এটাই আক্ষেপের বিষয়। তাদের আক্রান্ত শিশুকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে আসার ব্যাপারে আরও সচেতন করতে হবে। তাহলে ২০২৫ সালের মধ্যে প্রতি হাজার শিশুর মধ্যে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার তিনজনে নামিয়ে আনার যে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে তা অর্জন করা সম্ভব হবে।