সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মোটামুটি ১৪-১৫ বা ১৬-১৭ বছর বয়স পর্যন্ত পরিবারের দেওয়া নামে বেড়ে উঠলেও একটা সময়ের পরে তৃতীয় লিঙ্গর শিশুটি তথা হিজড়ারা নতুন নাম পায়। এই যেমন আলাউদ্দিন হয়ে গেছে আঁখি হিজড়া, গৌতম সরকার এখন অনন্যা বণিক বা আনোয়ার হোসেন শুভর পরিচিতি এখন শোভা সরকার নামে।
আরও আছে। সাভারের পলাশবাড়ির রাজু এখন মণীষা হিজড়া। ‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশন’-এ রিসেপশনিস্ট হিসেবে কর্মরত চৈতীর পারিবারিক নাম মামুন মোল্লা। ‘বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’তে লিয়াজোঁ অফিসার হিসেবে কর্মরত শাম্মী হিজড়ার প্রকৃত নাম সামিউল আলম। ধামরাইয়ের হাজিপুরের ফারুক এখন হেনা হিজড়া। হেনা হিজড়ার ব্যাপারে জানা যায়, হিজড়া হলেও পরিশ্রমী এবং সংসারের একমাত্র আয়ের উৎস হওয়ায় গরিব পরিবারে একসময় তার কদর ছিল। নিজে ভাতের মাড় খেয়ে ভাইবোনদের ভাত খেতে দিতেন। কষ্ট করে ভাইবোনদের পড়াশোনা শিখিয়ে মানুষ করে এখন তিনি বিতাড়িত। হেনাকে তার পরিবার আর ঠাঁই দেয়নি বলেও জানান তার সহকর্মীরা।
প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালে সরকার হিজড়াদের ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ফলে তাদের সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। সে সময় তাদের ট্রাফিক পুলিশে চাকরি দেওয়ার সিদ্ধান্তও নিয়েছিল সরকার। তবে পরে আর এ বিষয়ে কোনও আগ্রগতি জানা যায়নি। এদিকে দেশে হিজড়া জনগোষ্ঠীর সংখ্যা নিয়ে সঠিক কোনও পরিসংখ্যান নেই বলে বিভিন্ন সময় অভিযোগও উঠেছে। ২০১২ সালের সরকারি হিসাব অনুযায়ী দেশে হিজড়ার সংখ্যা ১২ হাজারের মতো। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে বসবাসকারী তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার।
হিজড়াদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মোটামুটি ১৪-১৫ বছর বয়স থেকে তাদের মূল যুদ্ধটা শুরু হয়। পরিণত বয়সের অগেই তারা পরিবার ও সমাজ থেকে বিতাড়িত হয় অথবা স্বেচ্ছায় নির্বাসনে চলে যায়। অনেক সময় সমাজ ছাড়তে বাধ্যও করা হয় তাদের। তখন তারা আশ্রয় পায় তৃতীয় লিঙ্গের সমাজে, তাদের গুরু-মা’র কাছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, টিকে থাকার প্রথম সংগ্রাম শুরু হয় পরিবার থেকে। এর পরের ধাপের প্রতিবন্ধকতা আসে সমাজের পক্ষ থেকে। কিন্তু এরমধ্যে বড় যে ধাক্কাটা আসে, তা হলো স্কুল থেকে। মূলত স্কুলে সহপাঠীদের আচরণ হিজড়াদের ক্ষুব্ধ করে তোলে। তাদের প্রতি সহপাঠীদের আচরণ কখনও কখনও বিরক্তিকর এমনকি হিংস্রও হয়ে ওঠে। ফলে হিজড়ারা সবার কাছ থেকে নিজেদের আলাদা করে ফেলে। তবু তাদের অনেকেই বলেছেন, পরিবার যদি তাদের পাশে দাঁড়ায় তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা সমাজ কোনও বাধা হতে পারে না। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আত্মীয়-স্বজন ও সমাজের অবস্থানের কারণে পরিবারও আর সন্তানটির পাশে থাকে না। কেউই ওই শিশুটিকে আর বুঝতে চায় না। ওই সন্তানটি একটু মমতা, ভালোবাসা ও স্নেহের খোঁজে আকুল থাকে। তারা যখন তাদের গুরুমা’র কাছে এসব পায়, তখনই তারা ঘর ছাড়ে। ঘর ছেড়েই তারা নতুন নাম পায়। আগের নাম পরিচয় মুছে ফেলে তারা। পরিচিত হয় নতুন নামে।
এ প্রসঙ্গে অনন্যা বণিক হিজড়ার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রথমে তার নাম ছিল গৌতম সরকার। জন্ম হয়েছে ঢাকার শ্যামপুরে। বড় হয়েছেন গেন্ডারিয়ায়। ৯ ভাইবোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। বাফা থেকে নৃত্যকলায় ডিপ্লোমা করেছেন। এখন তিনি একটি এনজিরও প্রধান।
নাম পরিবর্তনের ব্যাপারে গৌতম সরকার ওরফে অনন্যা বণিক হিজরা বলেন, ‘আমার গৌতম সরকার নামটা ১৮ বছর বয়সে হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে ছেলেবেলা। মানুষের কাছে পারিবারিক ছবির অ্যালবাম থাকে। আমাদের এসব কিছুই নেই। এখনকার পারিবারিক ছবির অ্যালবামেও আমি নেই। আছে কেবল স্মৃতি।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাবা-মা মারা যাওয়ার পরে তাদের কোনও কিছুই তাকে দেওয়া হয়নি। তাকে এখন আর পরিবারের সদস্য ভাবা হয় না। বোনেরা মাঝে মাঝে তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। গৌতম বলে ডাকে। ডাক শুনে চমকে উঠি। হারিয়ে যাওয়া নামটা কিছুক্ষণের জন্য ফিরে আসে। ব্যস! এটুকুই।’
পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালন করলেও পরিবার তাদের কোনও স্থান হয় না জানিয়ে তিনি আরও জানান, ভাগ্নিদের বিয়ের কেনাকাটা করে দিয়েছেন। সাজিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু বিয়ের অনুষ্ঠানে তাকে থাকতে দেওয়া হয়নি। মাঝে মাঝে তিনি গভীর রাতে গেণ্ডারিয়ায় গিয়ে রিকশায় ঘোরেন। শৈশব খোঁজেন। ছোটবেলার বন্ধুদের খুঁজে আড্ডা দেন গৌতম হয়ে। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘আমার বয়স এখন ৪১। ৪৫ হয়ে গেলে কী হবে আমি জানি না। যখন আমার সক্ষমতা থাকবে না, সৌন্দর্য থাকবে না, তখন কী হবে আমি জানি না।’
এ ব্যাপারে আরও কথা হয় আঁখি হিজড়ার সঙ্গে। জানা যায়, তার বাড়ি মূলত ভোলা। জন্মের পর তার নাম ছিল আলাউদ্দিন। ১৫ বছর বয়স থেকে বদলে যেতে থাকে তার জীবন। সে সময় তাকে পরিবারের কাছ থেকে নিয়ে যান তার হিজড়া গুরু-মা। এরপর থেকেই হিজড়া জীবন শুরু। তিনি এখন থাকেন সাভারের নবীনগরে। একটা বিউটি পার্লারে চাকরি করেন। আগের জীবন নিয়ে তার কোনও আক্ষেপ নেই। বরং হিজড়া জীবনে নিজের মতো করে থাকতে পারছেন, ইচ্ছে মতো সাজতে পারছেন, অন্যকে সাজাতে পারছেন, নাচতে পারছেন- এতেই তিনি আনন্দিত।
আঁখি বলেন, ‘আমি চলে যাওয়ার পরে আমার পরিবার মানে বাবা-মা, ভাইবোনরাও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। তারাও হয়তো মনেপ্রাণে চাইতো যে আমি যেন আর ওদের মধ্যে না থাকি।’
ছোটবেলায় নিজের পরিবর্তনের সময়কার অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘১৩-১৪ বছর বয়সে আমি বুঝতে পারি আমার ভেতরে পরিবর্তন আসছে। তখন মেয়েদের মতো চলতে থাকি। স্কুলে গেলে সবাই আমাকে হাফলেডিস বলতো। মেয়েদের সঙ্গে মিশতে আমার ভালো লাগতো। সাজতে ভালো লাগতো। সবাই বলতো হাফলেডিস অথবা হিজড়া। আলাউদ্দিন নামে আর কেউ ডাকতো না।’
জন্মসূত্রে পাওয়া নাম মুছে যাওয়ার ব্যাপারে বলেন, ‘নাম হারানোর সেই শুরু। ভাইবোনরা বলতো তুই মেয়েদের মতো সাজিস না। ওদের মতো করে চলিস না। কিন্তু আমার ওগুলোই ভালো লাগতো। গ্রামের লোকজনও অতিষ্ঠ করে ফেলতো। পরে হিজড়াদের এক গুরু-মায়ের সন্ধান পেয়ে নবীনগরে চলে আসি। তখন আমার হয় আঁখি হিজড়া। বাড়ি ছাড়ার পর জন্মসূত্রে পাওয়া আলাউদ্দিন নামটা ইলিশা আর সন্ধ্যা নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে এসেছি।’
এদিকে মিতুলের জীবনটা আবার অন্যরকম। ছোটবেলায় বাবা-মায়ের কাছ থেকে নাম পেয়েছিলেন তুলতুল। আর সার্টিফিকেটের নাম এস এম খায়রুন নবী। পড়াশোনায় ভালো ছিলেন। মিশ্র পোশাক (তার ভাষায় ইউনিসেক্স ড্রেস) পরলেও মন-মেজাজে শক্ত মানসিকতার ছিলেন বলে কো-এডুকেশনে পড়লেও কেউ তাকে ঘাঁটাতে সাহস পেত না। সবাই ভয় পেত তাকে। তিনিও সাজতে ভালোবাসতেন, এখনও বাসেন। পরিবার ছোটবেলায় তার পাশে ছিল, এখনও আছে। এজন্যই তিনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করতে পেরেছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে হিজড়াদের নিয়ে ‘হিউম্যান সাইকোলজি’ বিষয়ে তিনি পিএইচডি করতে চান। মিতুল বলেন, ‘পরিবারের সাপোর্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারের সদস্যরা শিক্ষিত হলে এসব কোনও সমস্যা নয়। পরিবার আমাকে আমার মতো করে থাকতে দিচ্ছে এটাই তো অনেক বড় পাওয়া। পারিবারিক সব সাপোর্ট আমার আছে।’
মিতুল আরও বলেন, ‘নাম একটা সমস্যা। আমার মূল নামটি অনেকটা মেয়েদের নামের মতো। ফলে কোনও সমস্যা হচ্ছে না। শিক্ষাক্ষেত্রে সবাই ভাবে এটা মেয়েদের নাম। আমি আমার নাম রেখেছি মিতুল। এটা দিয়ে ছেলেমেয়ে উভয়েরই নাম বোঝায়। আমি নিজের নাম তুলতুল মিতুল বলতেই বেশি পছন্দ করি। এই নামেই বেঁচে থাকতে চাই।’
হিজড়াদের নামের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সামিনা লুৎফা বলেন, ‘হিজড়াদের এই সমস্যা অনেক পুরনো। নাম আত্মপরিচয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এটা একটা পরিচিতি যা পরিবার থেকে আসে। আর হিজড়াদের নামটা নিজেদের বিনির্মাণ করতে হয়, অনেক সময় সমাজও নির্মাণ করে দেয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘জন্মের পরে পরিবারে থাকার সময় সবার একটা নাম থাকে। আবার তৃতীয় লিঙ্গ তথা হিজড়ারা তাদের গোষ্ঠীর সঙ্গে মেশার পরে তাকে নতুন নাম ধারণ করতে হয়। আত্মপরিচয় তৈরি করতে হয়। একটা নাম বাদ দিয়ে নতুন একটা গ্রহণ করতে হয়। সমাজও গ্রহণ করতে বাধ্য করে। এটা বেশ কষ্টের।’
হিজড়াদের প্রান্তিক গোষ্ঠী হিসেবে উল্লেখ করে ড. সামিনা লুৎফা বলেন, ‘সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন হিজড়ারা সমাজের একেবারে প্রান্তিক গোষ্ঠী। যে সমাজে এখনও নারী পুরুষের সমঅধিকার নিশ্চিত করা যায়নি সেখানে হিজড়াদের অধিকার প্রতিষ্ঠা অনেক দূরের একটি বিষয়। তবে হিজড়ারা সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি লাভের পরে কিছু পরিবর্তন এসেছে, যা তাদের জন্য কল্যাণ বয়ে আনছে।’
হিজড়াদের আত্মদ্বন্দ্বের বিষয়ে ড. সামিনা লুৎফা আরও বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রে একটা জটিল অবস্থাও তৈরি হয় হিজড়াদের মধ্যে। তৃতীয় লিঙ্গের যেসব নারী বা পুরুষ হিজড়া পরিচয়ে পরিচিত হতে চায় তাদের একটা মানসিক দ্বন্দ্ব থাকে, ভেতরে ভেতরে একটা কনফ্লিক্টের জায়গা তৈরি হয় যে তারা চূড়ান্তভাবে হিজড়া হবে কিনা। নিজে পরিবর্তন হওয়া, নাম পরিবর্তন করা একটা জটিল প্রক্রিয়ার অংশ। সেই প্রক্রিয়া শেষে হিজড়া হয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠা বা গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ারও একটা ব্যাপার থাকে।’
এ সংক্রান্ত আরও খবর:
কর্মমুখী জীবনের প্রতি হিজড়াদের আগ্রহ বাড়ছে
অপর্যাপ্ত সরকারি বরাদ্দ হিজড়াদের ভাগ্য পরিবর্তন ভূমিকা রাখে না