উৎসবমুখর এই দিনটি শুরু হয়েছিলো কীর্তনের মধ্য দিয়ে। এরপরই শুরু হয় মূল অনুষ্ঠান।
‘মঞ্চ নাটক, টিভি নাটক ও চিত্রনাট্য’ শীর্ষক আলোচনার মধ্য দিয়ে বাংলা একাডেমির লনে শুরু হয়েছে ঢাকা লিট ফেস্টের দ্বিতীয় দিন। আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন চলচ্চিত্র নির্মাতা অমিতাভ রেজা, নাট্যকার ও সাংবাদিক মাহাবুব আজিজ, গবেষক সাইমন জাকারিয়া এবং নাট্যকার ও কবি আলতাফ শাহনেওয়াজ। অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা করেছেন অভিনেত্রী বন্যা মির্জা। মঞ্চ নাটক জীবন্ত মানুষের সঙ্গে যে সম্পর্ক স্থাপন করে সে বিষয়েই আলোচনা হয় এই আয়োজনে। মঞ্চ নাটক সব নাটকের মানদণ্ড এই আলাপেই শেষ হয় এই আয়োজন।
একই সময়ে বাংলা একাডেমির আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান লেখক আরিফ আনোয়ারের প্রথম উপন্যাস ‘দ্যা স্টর্ম’ নিয়ে হয় প্রাঞ্জল আলোচনা। অনুষ্ঠানের সঞ্চালক হিসেবে ছিলেন রিফাত মুনিম। ‘দ্য স্টর্ম’ উপন্যাসটি যে তৎকালীন বার্মা, ভারত, বাংলাদেশের অনেকগুলো গল্পকে এক করেছে, তাই এই আলোচনায় উঠে এসেছে।
আলোচনায় উঠে আসে নানা নারী জীবনে সংকটের কথা। মিডিয়া ট্রায়ালে বিশ্বাসী নন বলে নিজের মন্তব্য জানিয়ে দেন মনীষা কৈরালা। দর্শকের প্রশ্নের জবাবে এই মন্তব্য করেন বলিউডের সাড়া জাগানো এই অভিনেত্রী। এদিকে সাদা-কালোর তফাত নিয়ে ফুঁসে উঠেছিলেন নন্দিতা দাস। নিজের দেশে বা বিদেশে, বর্ণবৈষম্যভিত্তিক বিজ্ঞাপন প্রচারণার বিরুদ্ধে অনেক দিন ধরেই সোচ্চার ভারতীয় অভিনেত্রী ও নির্মাতা নন্দিতা দাস। বাংলাদেশে এসেও আরেকবার জানান দিলেন নিজের অবস্থান, ‘ফর্সা মানেই সুন্দর নয়।
এদিকে, একজন লেখক যখন একটি লেখা শুরু করেন তখন তার মনে কী সব ভাবনা খেলা করে? লেখকের এই সৃষ্টিশীলতার কথা জানতেই আয়োজিত হয় ‘হোয়্যার ডু দে কাম ফ্রম?’ শীর্ষক আলোচনাটি। ভাস্কর নভেরা প্রদর্শনী কেন্দ্রের দ্বিতীয় তলার মঞ্চটিতে উপস্থিত ছিলেন ভারতের হিমাঞ্জলি সংকর, চন্দ্রহাস চৌধুরী, অরূপ স্যানাল এবং সুদূর জার্মানির ওলগা গ্র্যাগাসনোয়া।
সুকুমার সেন একদা বলেছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বাসন্তিকা’ পত্রিকায় যে আধুনিক রচনা শুরু হয়েছিল উত্তরকালে কলকাতায় তা বিস্তার লাভ করেছিল। এমন কথাই উঠে আসে ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস: সংকট ও উত্তরণ’ শীর্ষক আলাপচারিতায়। কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে আলোচনা করেন রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক ও গবেষক ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. নিখিলেশ রায় এবং কবি ও অধ্যাপক সুমন গুণ। সেশনটি সঞ্চালনা করেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর মোহাম্মদ মুহসিন।
নিঃসঙ্গ শৈশবে বাবার সঙ্গে সোনোরান মরুভূমিতে প্রায়ই ঘুরতে যেতেন অ্যাডাম। ধূ ধূ মরুর বুকে প্রাণের অস্তিত্ব নেই, তবুও সেখানেই গভীরভাবে অনুভবে ধরা পড়ে প্রাণ। অ্যাডাম বিশ্বাস করেন, এই ‘দেখতে’ পারা আর না-পারার মধ্যে ফাঁরাক শুধুই অনুভবে। শিশু বয়সের এই বোধোদয় থেকেই সাহিত্যের পথে চলা শুরু অ্যাডাম জনসনের। কেলি ফ্যালকোনারের সঙ্গে এই বিষয়গুলো নিয়েই আলাপ জমান অ্যাডাম।
শিশুদের দিন
সকালে বাংলা একাডেমির বটতলার নজরুল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘পশু পাখির তিন গল্প।’ এ সেশনটিতে শিশুদের গল্প শুনিয়ে সঙ্গ দেন ফাতেমা-তুজ-জোহরা। এ সময় ভেন্যুতে আসা শিশুদের সঙ্গে ছিল নবাবগঞ্জ সরকারী প্রথমিক বিদ্যালয়ের শিশুরা ও স্যার জন উইলসন স্কুলের শিক্ষার্থীরা।শিশুতোষ সাহিত্যিক হিমাঞ্জলি শঙ্কর ‘সুপারডগস’ নামে একটি সেশন করেন। যেখানে তিনি শিশুদের গল্প পড়ে শোনান। দুপুরের দিকে শিশুদের জন্য আয়োজন ছিল মঞ্চ নাটকের। ‘থিয়েটার: দ্য লাস্ট ট্রি’ মঞ্চ নাটকটি শিশুদের সামনে মঞ্চস্থ করে বিদ্যাভুবন। আর পরিচালনায় ছিল শেখ আল মামুন।
শেষ বেলায়
ঢাকা লিট ফেস্ট ২০১৮’-এর দ্বিতীয় দিনের শেষ বিকেলে সেশনে বাংলা একাডেমির কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে আলোচনা হয় অনুবাদ শিল্প ও এর বর্তমান অবস্থা নিয়ে। গত চার বছর ধরে বাংলাদেশের সাহিত্যকে বহির্বিশ্বের অঙ্গনে নিয়ে যাওয়ার কাজ করছে ‘ঢাকা ট্রান্সলেশন সেন্টার’। তাদের উদ্যোগেই শুরু হয়েছে নতুন কার্যক্রম, নাম— ‘লাইব্রেরি অব বাংলাদেশ’।
‘ঢাকা ট্রান্সলেশন সেন্টার’ শীর্ষক এ আলোচনায় যোগ দিয়ে শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও অনুবাদক কায়সার হক, লেখক, অনুবাদক ও সম্পাদক খাদেমুল ইসলাম এবং অনুবাদক পুষ্পিতা আলম তাদের নিজেদের অভিমত তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন লেখক ও প্রাবন্ধিক রিফাত মুনিম।
ব্রেক্সিট বিষয়ে ‘দ্য গ্রেট বিট্রায়াল’ শিরোনামে সাক্ষাৎকার পর্বে ছিলেন ‘অরওয়েল’ পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক ও রাজনৈতিক লেখক জেমস মিক। লেখক ও সম্পাদক এড কামিংসের সঞ্চালনায় কথা বলেন তিনি মূলত ব্রেক্সিটের ওপর তার প্রকাশিতব্য বই ‘ড্রিমস অব লিভিং অ্যান্ড রিমেইনিং’ নিয়ে।
শেষ সন্ধ্যায় ছিলো কবিতা আবৃতি ও আনপ্লাগড কনসার্ট। প্রবার রিপনের সার্কাস দলটি শোনায় নানা গান।
এই দিনেই শেষবেলায় মোড়ক উন্মোচন হয়েছে ‘ইলিয়াস: ইলোজি অ্যান্ড ড্রিম’ বইটির। বাংলাদেশের কালজয়ী কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ওপর বইটি লিখেছেন শুভ্ররঞ্জন দাসগুপ্ত। বাংলা একাডেমির কসমিক টেন্টে বইটির মোড়ক উন্মোচনের পাশাপাশি ব্যক্তি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও তার কাজ নিয়ে আলোচনা হয়। আলোচক ছিলেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ছোট ভাই শিক্ষাবিদ অধ্যাপক খালেকুজ্জামান ইলিয়াস, ঔপন্যাসিক ইমদাদুল হক মিলন এবং অধ্যাপক আফসান চৌধুরী।
তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ জনমানুষের যুদ্ধ ছিল। আমি বিশ্বাস করি, জাতি একত্রিত হলে বিশ্বে যেকোনও কিছু করা সম্ভব। নিজের লেখা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এই বইটিতে দুটি জীবনের ভিন্ন গল্প আছে। একটি যুদ্ধের সময়ের, আরেকটি ২০০৮-এর আমার জীবনের। এটা মুক্তিযুদ্ধের কোনও ইতিহাস না। আমার জীবনের গল্প।
উল্লেখ্য, এবারের লিট ফেস্টে আলোচনা, পারফরম্যান্স চলচ্চিত্র প্রদর্শনীসহ নানা আয়োজনে শতাধিক সেশন থাকছে। আরও আছে আনপ্লাগড মিউজিক কনসার্ট। সম্ভাব্য সেশনের আনুষ্ঠানিক তালিকা ইতোমধ্যেই লিট ফেস্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। www.dhakalitfest.com-এ পাওয়া যাবে প্রোগ্রাম তালিকা।
আহসান আকবারএবার লিট ফেস্টে বাংলাদেশের সাহিত্যপ্রেমীদের জন্য সবচেয়ে বড় চমক হিসেবে থাকছেন ভারতীয় লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। বাংলা ভাষার লেখকদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা অতুলনীয়। ঢাকা লিট ফেস্টের শেষ দিনে তিনি যোগ দেবেন এই আয়োজনে, কথা বলবেন বাংলাদেশের সাহিত্যপ্রেমীদের সঙ্গে।
বিদেশি অতিথিদের মধ্যে এবার অংশ নিয়েছেন পুলিৎজার জয়ী মার্কিন সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ অ্যাডাম জনসন, পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখক ও কলামিস্ট মোহাম্মদ হানিফ, ব্রিটিশ উপন্যাসিক ফিলিপ হেনশের, বুকার বিজয়ী ব্রিটিশ উপন্যাসিক জেমস মিক, ভারতীয় জনপ্রিয় লেখিকা জয়শ্রী মিশরা, লন্ডন ন্যাশনাল একাডেমি অব রাইটিংয়ের পরিচালক ও কথাসাহিত্যিক রিচার্ড বেয়ার্ড, ভারতীয় লেখিকা হিমাঞ্জলি শংকর, শিশুতোষ লেখিকা মিতালি বোস পারকিন্স, ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল এশিয়ার প্রধান হুগো রেস্টল, মার্কিন সাংবাদিক প্যাট্রিক উইন, লেখক ও সাংবাদিক নিশিদ হাজারি।
দ্বিতীয়বারের মতো ঢাকা লিট ফেস্টে এসেছেন অস্কার জয়ী অভিনেত্রী টিলডা সুইন্টন। এবারও তিনি কথা বলেছেন নিজের লেখালেখি ও চলচ্চিত্র নির্মান নিয়ে কথা বলতে। তারকাদের তালিকায় এবার যুক্ত হয়েছেন বলিউড অভিনেত্রী মনীষা কৈরালা। ছিলেন অভিনেত্রী ও অ্যাক্টিভিস্ট নন্দিতা দাস। কথা বলেছেন তার নির্মিত চলচ্চিত্র মান্টো নিয়ে। বরাবরের মতোই তিনি সরব ছিলেন নারী অধিকার,হ্যাশ ট্যাগ মিটু নিয়ে।
বাংলাদেশের প্রায় দেড়শ’ লেখক, অনুবাদক, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ এ আয়োজনে যোগ দিয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন ড. আনিসুজ্জামান, আফসান চৌধুরী, আসাদুজ্জামান নূর, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, কামাল চৌধুরী, আসাদ চৌধুরী, ফখরুল আলম, ইমদাদুল হক মিলন, মঈনুল আহসান সাবের, সেলিনা হোসেন, শামসুজ্জামান খান, আনিসুল হক, কায়সার হক, খাদেমুল ইসলাম, অমিতাভ রেজা, মুন্নী সাহা, শাহনাজ মুন্নী ও নবনীতা চৌধুরীসহ অনেকে।
বাংলাদেশের সাহিত্য জগতে স্বনামধন্য ‘জেমকন সাহিত্য পুরস্কার’ লিট ফেস্টের দ্বিতীয় দিন শুক্রবার ঘোষণা করা হবে। একই দিনে লঞ্চ করা হয় ক্যামব্রিজ শর্ট স্টোরি প্রাইজ।
তিন দিনের এই সাহিত্য উৎসব চলবে আগামী শনিবার (১০ নভেম্বর) পর্যন্ত। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা একাডেমির সহযোগিতায় এই উৎসব পরিচালনা করছেন কথাসাহিত্যিক এবং বাংলা ট্রিবিউন ও ঢাকা ট্রিবিউনের প্রকাশক কাজী আনিস আহমেদ, কবি সাদাফ সায্ সিদ্দিকী ও কবি আহসান আকবার। ঢাকা লিট ফেস্টের টাইটেল স্পন্সর হিসেবে থাকছে বাংলা ট্রিবিউন ও ঢাকা ট্রিবিউন, কি-স্পন্সর হিসেবে থাকছে ব্র্যাক ব্যাংক। গোল্ড স্পন্সর এনার্জিস, স্ট্রাটেজিক পার্টনার ব্রিটিশ কাউন্সিল এবং পুরো আয়োজন ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে যাত্রিক।
ঢাকা লিট ফেস্টে অংশগ্রহণের জন্য রেজিস্ট্রেশন চলছে এই ঠিকানায়- https://www.dhakalitfest.com/register/। উৎসবের শেষ দিন পর্যন্ত রেজিস্ট্রেশন চলবে।