উপন্যাস: ফিকশন নামের ‘মুখোশ’ পরা বাস্তবতা




_71A8809বরফ যুগের সময়ে ‘ক্লভিস’ নামের একটি জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব ছিল। নৃতাত্ত্বিক হ্যাংক হান্নাহ গবেষণা করতে গিয়ে দেখেন এই ক্লভিস জাতিগোষ্ঠীর কারণে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে ৩৫টি বৃহদাকার স্তন্যপায়ী প্রাণি। আরও গভীরে যেতে গিয়ে হান্নাহ দেখতে পান এক ভয়ানক দৃশ্য! মানবজাতির আগের জীবনধারণের অভ্যাস, এর ধারাবাহিকতা এবং ভবিষ্যতের ওপর ভয়ঙ্কর প্রভাব দেখে বিচলিত হয়ে পড়েন হান্নাহ।
ওপরের গল্পটি পুলিৎজারজয়ী সাহিত্যিক অ্যাডাম জনসনের প্রথম উপন্যাস ‘প্যারাসাইটস লাইক আস’-এর। এই শিরোনামেরই এক সেশনে ঢাকা লিট ফেস্টের শেষ দিন শনিবার (১০ নভেম্বর) বাংলা একাডেমির কবি শামসুর রাহমান সম্মেলন কক্ষে ফিকশন সাহিত্যের দুই তারকা অ্যাডাম জনসন ও ফিলিপ হেনশার এক হন। তাদের আলাপচারিতার সূত্র ধরে পুরো অনুষ্ঠানটি উপভোগ্য করে তোলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক মন্ময় জাফর।
কলোনিয়াল ও কলোনিয়াল-উত্তর বাংলার ইতিহাস, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও সাহিত্য নিয়ে গবেষণা কর্ম রয়েছে মন্ময় জাফরের। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট-কলোনিয়াল স্টাডিজ গ্রুপের দীর্ঘ দিনের সদস্য তিনি।
শিক্ষণীয় এই আড্ডা শুরু করেন মন্ময় জাফর কিছু প্রশ্ন দিয়ে: ফিকশন সাহিত্য কী? কেবলমাত্র লেখকের কল্পনার বহিঃপ্রকাশ? যদি তা না-ই হয় তবে এর বুনিয়াদ কী?
ফিলিপ হেনশার বাথ স্পা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিয়েটিভ রাইটিং বিভাগের অধ্যাপক। সাহিত্যিক পরিচয়েও তিনি সমান পরিচিত। তার ঝুলিতে আছে বেশ কটি সম্মানজনক পুরস্কার। এর মধ্যে আছে ‘কিচেন ভেনম’ সমারসেট মম পদক। আর তার ‘সিন’স ফ্রম আরলি লাইফ’ জিতেছে ওনদাৎজে পুরস্কার। বুকার প্রাইজেরও সংক্ষিপ্ত তালিকায়ও জায়গা করে নিয়েছিলেন ‘দ্য ফ্রেন্ডলি ওয়ানস’ উপন্যাসের জোরে। তার সবশেষ এ উপন্যাসটির উপজীব্য ঢাকা ও শেফিল্ডে বাস করা দুটি পরিবারের গল্প।
ফি সপ্তাহে পাঁচটি করে উপন্যাস পড়া ফিলিপের অভ্যাস। উপন্যাসের রাজ্যে তার বিচরণ কোন স্তরে তা সহজেই অনুমেয়। এই ব্রিটিশ ঔপন্যাসিকের লেখালেখি শুরু হঠাৎ করেই, কোনও একবারের ইউরোপ সফরের মাঝে। ফিলিপ মনে করেন, কোনও সাহিত্যিক একজন সাধারণ মানুষের মতোই সমাজের বিভিন্ন স্তর প্রত্যক্ষ করেন। সব মানুষের মতো এই ঘটনাগুলোর আতিশয্য তাকেও নাড়া দেয়। সেই চরম বাস্তবতাই সাহিত্যিক তুলে আনেন ফিকশন নামের ‘মুখোশ’ পরিয়ে।
অ্যাডাম জনসনের আরেকটি পরিচয়, যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক। অধ্যাপনার ফাঁকে লেখালেখি শুরু করার পর এই উপন্যাস দিয়েই সাহিত্যিক অ্যাডামের আত্মপ্রকাশ। অ্যাডামের পৃথিবী দেখার ধরনটা একটু অন্যরকম। তার প্রত্যেক মানুষকেই পছন্দ হয়। কেন? প্রশ্ন করা হলে বলেন, ‘প্রতিটি মানুষই তার মতো করে মানবতাবোধের চর্চা করেন। খালি চোখে দেখা না গেলেও একবার তা অনুভব করতে পারলেই কেল্লা ফতে।’
‘প্যারাসাইটস লাইক আস’ উপন্যাসে হান্নাহ ও তার দুই শিক্ষার্থী পৃথিবীর ভয়ানক এক দুর্যোগ থেকে বেঁচে যান। চোখ মেলে দেখেন জনশূন্য পৃথিবী— ঠিক যেন হাজার বছর আগের পৃথিবী।
অ্যাডাম বলেন, ‘সাহিত্যের অঙ্গনে ফিকশনই একমাত্র জনরা যেখানে প্রাণ খুলে সব কথা বলে ফেলা যায়। আর ব্যক্ত এই কথাগুলো বলা হয় অন্য কারো কণ্ঠে। সবচেয়ে মজার বিষয়টি হলো, পাঠক যখন এই লেখা পড়েন তখন ওই কণ্ঠটিকে নিজের কণ্ঠ হিসেবেই মনে করেন।’
এই জন্যই বোধ হয়, সাহিত্যজগতে প্রবন্ধ, গবেষণা কর্ম বা এককথায় ননফিকশনের মতো একটু কাঠখোট্টা লেখাগুলোর চেয়ে ফিকশন লেখাগুলোর পাঠক জনপ্রিয়তা বেশি।