সারা বছরই ডেঙ্গু, সতর্ক থাকার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

ডেঙ্গু ছড়ায় এডিস মশা

বর্ষাকালেই সাধারণত ডেঙ্গু জ্বর হয়ে থাকে— এই ধারণা বদলে যাচ্ছে। এখন সারা বছরই কেউ না কেউ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন। হাসপাতালগুলোতেও বছরজুড়ে ডেঙ্গু রোগীদের দেখা মেলে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন আর নির্দিষ্ট কোনও মৌসুমে সতর্ক হলে চলবে না। বরং ডেঙ্গু থেকে রেহাই পেতে হলে সারা বছরই সতর্ক থাকতে হবে। 

এদিকে, এবছরের ১০ মার্চ পর্যন্ত সরকারি হিসাবে ৪৩ জন ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। স্বাস্থ্য  অধিদফতরের কন্ট্রোল রুমের  দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ৪৩ জন ডেঙ্গুরোগে আক্রান্ত হলেও চিকিৎসা নিয়ে তারা সবাই সুস্থ আছেন।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়েছেন মোট ১০ হাজার ১৪৮ জন। এদের মধ্যে ২৬ জন মারা গেছেন।

রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)-এর সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার এ এস এম আলমগীর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এখন সারা বছরই ডেঙ্গু জ্বর হচ্ছে। তবে ডেঙ্গুর সিজনে এটি আরও বেশি হয়। বছরের জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এই রোগের প্রকোপ বেশি থাকে। যদিও অনেকেই বলে থাকেন— বর্ষাকালে বেশি ডেঙ্গু জ্বর হয়। বাস্তবতা হচ্ছে, বর্ষাকালে  বৃষ্টির পরিমাণ যখন কমে আসে, তখন এই রোগের বিস্তার বাড়ে। যখন থেমে থেমে বৃষ্টি হয় তখনও ডেঙ্গু বেশি হয়। আর  টানা বৃষ্টি হলে  ডেঙ্গুর লাভা ধুয়েমুছে চলে যায়।’

তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গু নিয়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং খুলনায় আমাদের গবেষণা চলছে। যদিও এখন ডেঙ্গুর আতঙ্কজনক বৃদ্ধির কোনও খবর নেই, তবে ডেঙ্গু হচ্ছে।’

তিনি জানান, ‘ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা খুব ভোরে, সন্ধ্যায়, সূর্যাস্ত ও সূর্য ওঠার সময়টাতে বেশি আক্রমণ করে।’

ডেঙ্গু নিয়ে আইইডিসিআর-এর গবেষণা প্রসঙ্গে এ এস এম আলমগীর বলেন, ‘গত বছর আমরা একটা বাড়িতে গিয়েছিলাম। ওই পরিবারের সদস্যরা ছুটিতে গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলেন। ফিরে আসার পর তারা দেখতে পান, বালতিতে যে পানি রাখা ছিল  তার মধ্যে এডিস মশার লার্ভা জমে গেছে। আরেকটি বাড়িতে আমরা পেয়েছি— সেখানে পাঁচটি বাথরুম আছে। তিনটি ব্যবহার করলেও  দুটি বাথরু  ব্যবহার করা হয় না। কয়েকদিন পরে দেখা গেলো— অব্যবহৃত বাথরুমের কমোডের মধ্যে এডিস মশার লার্ভা।’

তিনি  বলেন, ‘ডেঙ্গুর ব্যাপারে নাগরিকদের সচেতন হওয়া দরকার। এডিস মশার কারণে এই রোগ হয়। এটি কন্ট্রোল করার সহজ উপায় হলো— নিজের বাড়িঘর নিজেকে পরিষ্কার রাখতে হবে। বাসায় ছাদ, ফুলের টব,ফুলদানিসহ বাসার চারদিক পরিষ্কার রাখতে হবে। বাসাবাড়ির কোথাও ময়লা জমতে দেওয়া যাবে না। কারণ, এডিস মশা মূলত বাড়িতেই বেশি হয়। ছুটিতে বাড়িতে যাওয়ার আগে বালতিতে রাখা পানি ও ফ্রিজের পেছনে জমা হওয়া পানি নিয়মিত ফেলে দিতে হবে।’

ডেঙ্গু প্রতিরোধ বিষয়ে ঢাকা জেলার সিভিল সার্জন ডা. এহসানুল করিম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ডেঙ্গু প্রতিরোধে এর বাহক এডিস মশাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এই মশা পরিষ্কার বদ্ধ পানিতে জন্মায়। ফুলের টব, নারকেলের খোসা, দই ও মিষ্টির খালি পাত্র বা মাটির পাতিল— এগুলোতে যে পানি জমে, তাতে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা জন্মায়। এমনকি আমরা বাড়িতে যে ছাদবাগান করি, সেখানেও ডেঙ্গুর বাহক জন্মায়। তাই এই রোগ প্রতিরোধে প্রথমেই মশার বাহককে দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এখন ডেঙ্গুর সময় না, এরপরও ডেঙ্গু হচ্ছে। এটা আসলে দুই-এক জনের হতে পারে। তবে, এই রোগ প্রতিরোধে ব্যক্তিগত পর্যায়ে এবং সরকারিভাবে সচেতনতা খুব জরুরি। নিজের বাসা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। মশা যেন কখনও কামড়াতে না পারে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। দিনে ঘুমালেও মশারি টাঙাতে হবে বা স্প্রে করতে হবে। শিশুরা হাফপ্যান্টের বদলে ফুলপ্যান্ট পরবে। খেয়াল রাখতে হবে— মশা যেন কোনোভাবেই না কামড়াতে পারে। আর সরকারি পর্যায়ে সিটি করপোরেশনের কাজ হলো— যেখানে সেখানে যেন ডাবের খোসা না থাকে, টিনের ক্যানে পানি জমতে না। মশার বংশ যেন বিস্তার লাভ করতে না পারে, ব্যক্তিগত এবং সরকারি পর্যায়ে এই উদ্যোগ নিতে হবে।’ 

ডেঙ্গুর চিকিৎসা প্রসঙ্গে ডা. মো. এহসানুল করিম বলেন, ‘এই রোগের স্পেসিফিক কোনও চিকিৎসা নেই। এটি মশাবাহিত রোগ। ডেঙ্গু রোগের উপসর্গ ধরে চিকিৎসা দিতে হয়। ডেঙ্গু হলে শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। চিকিৎসকরা ব্যথার চিকিৎসা করেন। যদি কোনও কারণে রক্তের প্ল্যাটিলেটের মাত্রা কমে যায়, তাহলে এই প্ল্যাটিলেট বাড়ানোর জন্য চিকিৎসা করাতে হবে। একইসঙ্গে জ্বরের চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে। শরীরে তরল পদার্থের মাত্রা ঠিক রাখতে হবে। নিয়মিত প্রচুর পরিমাণে পানি খেতে হবে।’

তিনি বলেন, আমাদের সব হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে যে চিকিৎসকরা আছেন, তারা নিয়মিতই ডেঙ্গুর রোগীর চিকিৎসা করছেন। চিকিৎসকের মূল কাজ রোগীর ব্যথা এবং জ্বর দূর করা। চার-পাঁচ দিনে এই রোগ এমনিতেই ভালো হয়ে যায়।’

অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘এই রোগ নিয়ে এখন মানুষের মধ্যে অনেক সচেতনতা বেড়েছে। তারপরও ডেঙ্গু হলে ভয় পাওয়া যাবে না। এটা এত কঠিন রোগ না, রোগ হলে চিকিৎসা করে সুস্থ হওয়া যায়। তবে ডেঙ্গু যাতে না হয়, সেজন্য সচেতন থাকতে হবে।’