মোহাম্মদপুরের বসিলায় নিহত দুই জঙ্গির পরিচয় শনাক্ত করা নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। জঙ্গি আস্তানার ভেতরে একাধিক শক্তিশালী বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় জঙ্গিদের বিচ্ছিন্ন হাত, পা ও মুখমণ্ডল পুড়ে বিকৃত হয়ে গেছে। তাই সাদা চোখে তাদের শনাক্ত করা সম্ভব না। আগুনে তাদের হাতের আঙুল পুড়ে যাওয়ায় ছাপ নিয়ে তাদের পরিচয় শনাক্ত করাও সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় ডিএনএ টেস্টই শেষ ভরসা বলছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)-২ এর অধিনায়ক আশিক বিল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা তাদের পরিচয় শনাক্ত করার চেষ্টা করেছি। তবে তারা যে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে তাতে পুরো শরীর উড়ে গেছে। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। জঙ্গি আস্তানায় থাকা বিস্ফোরকে আগুন ধরে যাওয়ায় তাদের হাতের আঙুল, মুখমণ্ডলও পুড়ে গেছে। তাই খালি চোখে তাদের শনাক্ত করা সম্ভব না। দু’জনেরই ডিএনএ প্রোফাইল করা হবে।’
নিহত দুই জঙ্গির পরিচয় শনাক্তের জন্য একাধিক পদ্ধতিতে চেষ্টা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে অভিযানকারী বাহিনী র্যাব, ফরেনসিক বিভাগ ও স্থানীয় থানা পুলিশ। তবে কোনোটিতেই সফলতা আসেনি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের পরিচয় নিশ্চিত হতে পারেনি।
মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, অভিযান শুরুর পরপরই বাড়িটিতে ভাড়া থাকা সন্দেহভাজন দু’জন যুবকের কোনও তথ্য থানায় দেওয়া আছে কিনা তা খোঁজ করা হয়। কিন্তু কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি। কারণ, তারা কোনও ভাড়াটিয়া ফরম পূরণ করেননি। এদিকে বাড়ির মালিক ওয়াহাব মিয়া ওই বাড়িতে না থাকলেও কেয়ারটেকার সোহাগ দায়িত্বে ছিলেন। তিনিও ভাড়াটিয়াদের কোনও তথ্য সংরক্ষণ করেননি।
তবে ঠেলাঠেলির কারণে নয়, ওই বাড়িতে কেউ অবস্থান করছে এমন কোনও তথ্য না থাকায় ভাড়াটিয়াদের তথ্য সংগ্রহ করা হয়নি বলে জানিয়েছে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ।
এদিকে অভিযানের পর নিহত দু’জনের হাতের আঙুলের ছাপ নিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সেখানেও ব্যর্থ হন অভিযানে থাকা কর্মকর্তারা। কারণ, সুইপিংয়ের মাধ্যমে অভিযান শুরুর পর আস্তানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। অভিযান শুরুর আগে জঙ্গিদের ঘটানো বিস্ফোরণে ঘরের বিভিন্ন অংশ উড়ে যায় এবং আগুন থেকে ধোঁয়া উঠতে থাকে। ছোট ছোট আগুন ও ঘরের মধ্যে থাকা আইইডি বিস্ফোরিত হয়ে পরে বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। আগুনে নিহত দুই জঙ্গির বিভিন্ন অঙ্গের অবশিষ্ট অংশও পুড়ে যায়। একই সঙ্গে পুড়ে যায় দু’জনের হাতের আঙুলের তালু। যে কারণে আঙুলের ছাপ নিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র বের করা সম্ভব হয়নি বলে জানা গেছে।
তিনি বলেন, ‘বিস্ফোরণেই তাদের মৃত্যু হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছে।’
অভিযান শুরু থেকে শেষ
২৮ এপ্রিল দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে মোহাম্মদপুরের বসিলায় মেট্রো হাউজিং এলাকার একটি টিনশেড বাড়িতে অভিযান চালায় র্যাব-২ এর একটি দল। তাদের কাছে তথ্য ছিল বাড়িটিতে দু’জন জঙ্গি রয়েছে। এই তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালাতে গিয়ে প্রথমে বাড়ির কেয়ারটেকার সোহাগের কক্ষে কড়া নাড়া হয়। সোহাগের স্ত্রী মৌসুমী বেরিয়ে আসে। তার সঙ্গে কথা বলার ফাঁকেই পাশের কক্ষ থেকে র্যাবকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে সন্দেহভাজন দুই জঙ্গি। এরপর র্যাব সদস্যরা বাড়িটি থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নেয় এবং আশপাশের বাড়ির বাসিন্দাদের সরিয়ে নিয়ে আসে। র্যাব অবস্থান নিয়ে পাল্টা গুলি চালায় এবং বাড়িটি ঘিরে রাখে। ঘেরাও করে রাখার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বাড়িটি থেকে একটি বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায় এবং ভোর পাঁচটার দ্বিতীয় বিস্ফোরণ হয়।
দুপুর ১২টায় ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছায় সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের সদস্যরা। তারা বাড়িটি প্রবেশ করে ক্রাইমসিন সংগ্রহ করেন।
এদিকে সুইপিং অভিযান চলাকালে চারটি অবিস্ফোরিত আইইডি উদ্ধার করে র্যাবের বোম্ব ডিসপোজাল টিম। দুপুর দেড়টার দিকে সেগুলো নিষ্ক্রিয় করা হয়। প্রায় ১৪ ঘণ্টা পর বিকেল চারটার দিকে অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করেন র্যাব-২ অধিনায়ক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ।
তিনি বলেন, প্রায় ১৪ ঘণ্টা পর অপারেশন শেষ হয়েছে। রাত আড়াইটা থেকে শুরু করে এখন শেষ হলো। বাড়িটি থেকে দু’জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া দুটি বিদেশি পিস্তল, কয়েক রাউন্ড তাজা গোলাবারুদ, ম্যাগজিন, চাপাতি, ছোড়া, তিনটি মোবাইল এবং অবিস্ফোরিত তিনটি আইইডি উদ্ধার করা হয়েছে। নিহত দু’জনের পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য সিআইডি’র ফরেনসিক বিভাগ নমুনা সংগ্রহ করেছে বলেও জানান তিনি।
ছবি: সাজ্জাদ হোসেন