এদিকে তদন্ত সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, এটিএম জালিয়াতি করা এই চক্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বড় একটি সিন্ডিকেট জড়িত রয়েছে বলে তারা ধারণা করছেন। কারণ, ভিতালি নামে এক ইউক্রেনীয় নাগরিকের এখনও পালিয়ে আছে। গ্রেফতার হওয়া নাগরিকরা উত্তোলিত টাকা ওই সিন্ডিকেটের সদস্যদের কাছে পার করে দিয়েছে। গ্রেফতার হওয়ারাও অনেক চতুর। জিজ্ঞাসাবাদে তারা জালিয়াতির কথা স্বীকার করছে না, তবে অনেক প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার শাহিদুর রহমান রিপন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এই সিন্ডিকেটের সকল সদস্যকে আমরা শনাক্ত ও পুরো রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য নিরন্তর চেষ্টা করে যাচ্ছি। গ্রেফতারকৃতদের দ্বিতীয় দফায় চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে। তবে এখনও তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আনা হয়নি। এই ফাঁকে তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে এবং ফরেনসিক পরীক্ষার মাধ্যমে জালিয়াতির প্রক্রিয়া জানার চেষ্টা চলছে।’
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এটিএম জালিয়াতির এই চক্রটির সঙ্গে দেশি-বিদেশি একটি বড় সিন্ডিকেট জড়িত রয়েছে। আর গ্রেফতার হওয়ারাও খুব চালাক। জিজ্ঞাসাবাদে তাদের এটিএম বুথ থেকে টাকা তোলার দৃশ্য দেখালেও তা অস্বীকার করার চেষ্টা করছে। জালিয়াতির পরপরই তারা নিজেদের কাছে থাকা বাংলাদেশি মুদ্রাগুলো অন্য কারও কাছে দিয়ে দিয়েছে।
ইউক্রেনের নাগরিকদের জিজ্ঞাসাবাদকারী একজন কর্মকর্তা জানান, তারা বাংলাদেশে ঘুরতে এসেছিল দাবি করলেও বাংলাদেশের কোনও দর্শনীয় স্থানের নাম তারা বলতে পারেনি। একজন মাত্র কক্সবাজারের কথা জানে। একইসঙ্গে তারা বিমানবন্দরের ভেতরেই মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান থেকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা ডলার ভাঙানোর দাবি করে। কিন্তু বিমানবন্দরের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, তারা ইমিগ্রেশন শেষ করে সোজা বাইরে বের হয়ে এসেছে। তারা কোনও মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানে যায়নি।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, তারা বাংলাদেশি ওই যুবক ছাড়াও ভিতালি নামে পলাতক ওই ইউক্রেনীয়কেও গ্রেফতারের জন্য অভিযান চালাচ্ছেন। কারণ বাংলাদেশি যুবককে আটক করতে পারলে বাংলাদেশি সিন্ডিকেট সম্পর্কে জানা যেতে পারে। এছাড়া ভিতালিকে গ্রেফতার করতে পারলে তার কাছ থেকেও অনেক তথ্য জানা যাবে। উত্তোলন করা টাকাগুলো কোথায় সেটাও জানা যাবে।
সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, তাদের হাতে গ্রেফতার হওয়া ছয় ইউক্রেনের নাগরিকদের একজন, ভ্যালেনটাইনের কাছ থেকে চারটি পাসপোর্ট উদ্ধার করা হয়েছে। জালিয়াতির কারণেই সে একাধিক পাসপোর্ট ব্যবহার করতো।
পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলছেন, তাদের ধারণা বাংলাদেশের ভেতর থেকে কোনও একটি বড় সিন্ডিকেট আইনজীবীর মাধ্যমে তাদের জামিন করানোর ব্যবস্থা করছে।
তবে যোগাযোগ করা হলে গ্রেফতার হওয়া ইউক্রেনের নাগরিকদের আইনজীবী এফ এম মাসুম জানিয়েছেন, দিল্লি থেকে ইউক্রেন দূতাবাসের একজন প্রথম সচিব তার সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে নিয়োগ করেছেন। তিনি দাবি করেন, গ্রেফতার হওয়া ইউক্রেনের নাগরিকরা সবাই নিজ দেশের ‘স্পোর্টসম্যান’। কারাগারে তাদের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য দিল্লির ইউক্রেন দূতাবাস থেকে কূটনৈতিক চ্যানেলে যোগাযোগও করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
এনসিআর-এর বিশেষজ্ঞরা ঢাকায়
দুনিয়াজুড়ে অটোমেটেড টেলার মেশিন বা এটিএম সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এনসিআর করপোরেশনের বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ঢাকায় এসেছেন। ঢাকায় এটিএম জালিয়াতির বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বুধবার তাদের সঙ্গে বৈঠক করবে তদন্ত সংশ্লিষ্ট ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। কীভাবে জালিয়াতি হয়েছে এবং তাতে কী ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে তা জানার চেষ্টা করা হবে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, তারা জব্দ করা এটিএম সদৃশ্য কার্ডগুলোর ফরেনসিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখছেন। একইসঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইয়ের সঙ্গেও যোগাযোগের চেষ্টা করছেন। জালিয়াতিতে ব্যবহৃত এটিএম সদৃশ্য কার্ডগুলোর মধ্যে কী ধরনের প্রযুক্তি ছিল তা জানাই হলো মুখ্য বিষয়। এটি জানতে পারলে চক্র শনাক্তের পাশাপাশি ভবিষ্যতে সাইবার সিকিউরিটি নিয়েও সতর্ক থাকা যাবে বলে জানান কর্মকর্তারা।
গত ১ জুন সন্ধ্যায় রাজধানীর খিলগাঁও তালতলা এলাকার ডাচ-বাংলা ব্যাংকের একটি বুথ থেকে অভিনব পদ্ধতিতে জালিয়াতি করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার সময় ইউক্রেনের এক নাগরিককে আটক করে বুথের নিরাপত্তাকর্মী। পরে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রাতে পান্থপথের হোটেল ওলিও ড্রিম হ্যাভেনে অভিযান চালিয়ে আরও পাঁচ নাগরিককে গ্রেফতার করা হয়। তবে অভিযানের বিষয়টি টের পেয়ে ভিতালি (পাসপোর্ট নম্বর এফই ৮০৪৪৪৮) নামে তাদের এক সঙ্গী পালিয়ে যায়।
পুলিশ ও ডাচ বাংলা ব্যাংক সূত্র জানায়, খিলগাঁওয়ের ঘটনার একদিন আগে এই চক্রটি রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে মোট নয়টি এটিএম বুথ থেকে মোট ১৬ লাখ টাকা টাকা তুলে নেয়। এমন পদ্ধতিতে তারা টাকা তুলেছিল যাতে টাকা উত্তোলনের কোনও তথ্যই ব্যাংকের কেন্দ্রীয় সার্ভারের হিসাবে তারতম্য ঘটায়নি। এমনকি কোনও গ্রাহকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকেও টাকা কাটা যায়নি।